সার্ক কি হারিয়ে যাচ্ছে?

গত বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত বিমসটেক নেতাদের বৈঠকে যেসব আলোচ্যসূচি নির্ধারিত হয়েছিল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লিতে বিমসটেক নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের এই বৈঠক হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বে ব্রিকস সম্পর্কে প্রচার-প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিমসটেক নেতাদের গোয়ায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ, সে হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোটাই বেশি যৌক্তিক ছিল। কিন্তু ভারত করল কি, সার্কের বদলে বিমসটেক নেতাদের আমন্ত্রণ জানাল।

ভারতের এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বোঝাটা খুব জরুরি, যেখানে ভারত কিনা সার্ক ও বিমসটেক দুটি সংস্থারই সদস্য। সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার আটটি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান। অন্যদিকে বিমসটেকে এই সার্কের পাঁচটি সদস্যরাষ্ট্র (নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশ মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড রয়েছে। এই দুটি দেশ আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের সদস্য।

সার্ক গঠিত হয়েছ ১৯৮৫ সালে। অন্যদিকে বিমসটেক গঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। সার্ক অতীতে নানা ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করেছে এবং বেশির ভাগ সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের কারণে। কাশ্মীর, সন্ত্রাসবাদ ও পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সমস্যা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সার্কের কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে। যদিও সার্ক কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে তার প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করার অনুমিত দেয় না, কিন্তু সার্কের এই বিধি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে থামাতে পারেনি এবং এ দুটি দেশের দ্বন্দ্বের ফলে উদ্ভূত সমস্যা সংস্থাটির কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

এদিকে বিমসটেক সারা বিশ্বের মনোযোগ খুব কমই আকর্ষণ করতে পেরেছে। বিমসটেকের সব সদস্য হয় সার্ক, নয়তো আসিয়ানের সদস্য। এই দুটি সংস্থাই তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে শক্তিশালী আঞ্চলিক জোট। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কাছে তারা বিমসটেকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় হিসেবে বিবেচিত। এটা স্পষ্ট হয় বিমসটেকের অনিয়মিত সম্মেলনে—২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি সম্মেলন হয়েছে। এর সব সদস্যরাষ্ট্র নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে। তারপরও বিমসটেকের কার্যক্রম তার সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে সেভাবে উদ্দীপিত করতে পারে না, যেটা সার্ক বা আসিয়ান পারছে।

ঐতিহাসিকভাবে ভারত বিমসটেক কাঠামোর আওতায় দ্বিপক্ষীয় স্তরে সম্পর্ক বজায় রাখার বদলে একটি আঞ্চলিক অ্যাজেন্ডা গড়ে তোলার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। যা-ই হোক, ভারত সার্কের একটি সক্রিয় সদস্য, যার সঙ্গে প্রতিবেশীদের অপেক্ষাকৃত ভালো সম্পর্ক রয়েছে, যা কিনা ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্যগুলোর একটি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটি এখন সার্কের চেয়ে বিমসটেকের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যার কারণে ভারত এ রকম করছে। সার্কের কাঠামোর আওতায় পাকিস্তান যেকোনো ধরনের আঞ্চলিক সহযোগিতার বিরোধিতা করছে। পাকিস্তান সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের বিভিন্ন উদ্যোগের বিরোধিতার পাশাপাশি সার্ক স্যাটেলাইট প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সার্কের ইস্যুগুলোতে পাকিস্তানের আপসহীন মনোভাব সংস্থাটির বাকি সদস্যদেশগুলোকে হতাশ করেছে। এই হতাশার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি সদস্যদেশগুলোর সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বর্জনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া পাকিস্তান দুটি সদস্যরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে। পাকিস্তানের অনমনীয় মনোভাব এবং ভারতবিরোধিতা এ অঞ্চলে সার্কের কোনো কিছু অর্জন করা কঠিন করে তুলছে।

সার্ক এখন উভয়সংকটে রয়েছে। পাকিস্তান ছাড়া সংস্থাটি কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না, কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান সার্কের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কার্যক্রম এগোতে দিচ্ছে না। এই অচলাবস্থা নিরসনে ভারত এখন বিমসটেকের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। বিমসটেক ভারতের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশীদের অন্তর্ভুক্ত করেছে, যারা কিনা সার্কেরও অংশ। পাকিস্তান ছাড়াও বিমসটেক সার্কের আরও দুটি রাষ্ট্র আফগানিস্তান ও মালদ্বীপকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে ভারত এখন আফগানিস্তান ও মালদ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কৌশলগত অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ভারত সক্রিয়ভাবে মালদ্বীপের সঙ্গেও তার সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মালদ্বীপ সফর করেছেন।

বিমসটেকের প্রতি ভারতের মনোযোগ দেওয়ার ফলে পাকিস্তানের বৈরিতার মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই আঞ্চলিক সহযোগিতার কার্যক্রম বাস্তবায়নের একটি সুযোগ সৃষ্টি হলো। বিমসটেকের সদস্যদেশগুলোর মাধ্যমে ভারত এখন স্থলপথ ও সমুদ্রপথ ব্যবহার করে ভিয়েতনাম ও লাওসের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে।

ভারতের এসব উদ্যোগ এই আভাস দিচ্ছে যে পাকিস্তানকে একঘরে করার জন্য ভারতের নীতিনির্ধারকেরা একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন করছেন। সার্ক ও বিমসটেকে ভারতের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক শক্তি একটি বড় ব্যাপার। ভারত একটি উদীয়মান অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোর সদস্যদেশগুলোর জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য একটি বড় বাজার হতে পারে। ভারতের আকর্ষণীয় বাজার এবং সামরিক সক্ষমতা ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গুণনীয়কে পরিণত হবে, যা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করবে।

বিমসটেকের দিকে বেশি বেশি মনোযোগের কারণে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে সার্কের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে, যদিও ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে পাকিস্তান। পাকিস্তান যদি সার্কের ব্যাপারে তার কৌশলের বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে ভাবনা-চিন্তা না করে, তাহলে ভারত এবং অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের পক্ষে সার্কের ব্যাপারে আগ্রহ ধরে রাখাটা কঠিন হবে। ভারত ও পাকিস্তানের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সার্ক কোনো কাজ করতে বা দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রোকেয়া রহমান, দ্যডিপ্লোম্যাট.কম থেকে নেওয়া।

সংকল্প গুরজার: নয়াদিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন পিএইচডি প্রার্থী।