ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ: কলকাতা ও সিঙ্গাপুর পারলে আমরা কেন পারি না

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর ধরে যে ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা এখানে অনুপস্থিত
ফাইল ছবি

ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব, প্রজননস্থল এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা—সব বিবেচনাতেই এ বছরে ডেঙ্গু ভয়ানক রূপ নেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি হিসাবে গত বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রেকর্ডসংখ্যক ২৮১ জন মারা গিয়েছিলেন। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের চেয়েও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, আক্রান্ত রোগী ও মশার ঘনত্ব উভয়ই গত বছরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

প্রথম আলো জানাচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্-বর্ষা জরিপে ঢাকার দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিতেই মশার ঘনত্ব পরিমাপক সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ ২০-এর বেশি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। অথচ গত বছর ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৩টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি ছিল। একইভাবে ৯৮টি ওয়ার্ডের ৮০টি ওয়ার্ডেই এডিস মশা পাওয়া গেছে এমন বাড়ির শতকরা হার বা হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি পাওয়া গেছে। অথচ গত বছর হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি ছিল ১৯টি ওয়ার্ডে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন এই ছয় মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৯ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১। কিন্তু এ বছর প্রথম ছয় মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৯৭৮ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৪৭ জনের। ফলে শুধু এডিস মশার ঘনত্ব বা প্রজননস্থলের সংখ্যাই নয়, হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও মৃতের সংখ্যাগত বিবেচনা থেকেও ডেঙ্গু পরিস্থিতির গুরুতর অবনতির স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সারা বছর ধরে যে ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না বলেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটছে।

এডিস মশা যে শুধু মানুষের ঘরের ফুলের টবে কিংবা ছাদে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতেই হয়, তা নয়। বিভিন্ন পাবলিক প্লেস এবং বিশেষত সরকারি–বেসরকারি নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনায় পড়ে থাকা বোতল, প্যাকেট, ডাবের খোসা, কনটেইনার, ড্রাম, ব্যারেল, পরিত্যক্ত টায়ার, ইটের গর্ত ইত্যাদিতে জমে থাকা পানিতে জন্মাতে পারে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ থেকে দেখা গেছে, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে যেসব উৎসে, সেগুলো হলো পরিত্যক্ত টায়ার (২২.৯০ %), বেজমেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি (১১.২৯ %), প্লাস্টিকের ড্রাম (৭.৭৪ %) ইত্যাদি। এ ছাড়া আর যেসব স্থানে এডিস মশা পাওয়া যায় সেগুলো হলো, পানির ট্যাংকি (৪.৮৪ %), প্লাস্টিকের বালতি (৪.৮৪ %), ফুলের টব ও ট্রে (৩.৮৭ %), মাটির পাত্র (৩.৮৭ %), রঙের কৌটা (৩.৫৫ %), টিনের ক্যান (৩.২৩ %), প্লাস্টিকের মগ/বদনা (২.৯০ %) ইত্যাদি।

এ কারণেই ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল ঢাকায় এসে বলে গিয়েছিলেন, নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো এডিস মশার অন্যতম বড় উৎস, এখানকার মশা উৎপাদনক্ষেত্র বিনাশ করা সম্ভব হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। পরিত্যক্ত টায়ার কিংবা নির্মাণ প্রকল্পে যেন এডিস মশা জন্মাতে না পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের।

এমনকি ব্যক্তিমালিকানাধীন হাউজিং প্রোপার্টির ভেতরে জমে থাকা পানি পরিষ্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করা ও বাধ্য করার দায়িত্বটাও জনগণের করের টাকা চলা সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের।

এর বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা দেখতে পারি কলকাতা সিটি করপোরেশন এডিস মশা দমনের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে—১৪৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতেই সিটি করপোরেশনের ২০ থেকে ২৫ জন করে কর্মী থাকেন, যাঁদের মধ্যে একদল প্রচারের কাজ চালায়, আর অন্য দল কোথাও পানি জমছে কি না, সেটার ওপরে নজর রাখে। ১৬টি বরোর (borough) প্রতিটির জন্য থাকে একটি করে র‍্যাপিড অ্যাকশন টিম। তাতে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত থাকেন ৮ থেকে ১০ ব্যক্তি, গাড়িও থাকে তাঁদের কাছে। কোনো জায়গায় ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে অতি দ্রুত তাঁরা সেখানে পৌঁছে এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সারা বছর নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম চালানো হয় না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্রেফ আগাম সতর্কতা জানিয়ে দায়িত্ব সারে, সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আগাম সতর্কতা পাওয়ার পরও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয় না, এমনকি যখন ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করে তখনো কিছু অনিয়মিত অভিযান ছাড়া আর তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ বোধ করে না।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কেমন হতে পারে, তার একটা দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত হলো সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (এনইএ) কর্মীরা নিয়মিত মানুষের ঘরে ঘরে এবং এলাকায় এলাকায় গিয়ে পাবলিক স্পেস, কনস্ট্রাকশন সাইট এবং হাউজিং এস্টেটে ডেঙ্গু মশার জন্মস্থল খুঁজে ধ্বংস করে থাকে। পরিদর্শন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কনস্ট্রাকশন সাইটের মতো সম্ভাব্য বিপজ্জনক স্থানের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরের আইন অনুসারে নির্মাণকাজের সময় কন্ট্রাক্টরদের পেস্ট কন্ট্রোল অফিসার ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ দিতে হয় যাদের কাজ হলো প্রতিদিন সকালে মেঝে পরিষ্কার করা এবং দুই সপ্তাহে একবার মশকরোধী তেল প্রয়োগ করা যেন এসব সাইটে জমা পানিতে মশা জন্মাতে না পারে, বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে মশার লার্ভা মারা যায়। এনইএ প্রতি মাসে অন্তত একবার কনস্ট্রাকশন সাইটগুলো পরিদর্শন করে, আইন ভঙ্গ করলে জরিমানা করা হয় এমনকি সাময়িক ভাবে কাজ বন্ধ করেও দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

ডেঙ্গু প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো ডেঙ্গু উপদ্রুত এলাকাগুলোকে ‘ডেঙ্গু ক্লাস্টার’ হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা এবং সেখানে এডিস মশার উৎসস্থল খুঁজে বের করে ধ্বংস করা ও স্থানীয় জনগণকে সচেতন ও সতর্ক করা।

সিঙ্গাপুরে কোনো একটি আবাসিক এলাকায় বা ব্লকে যদি ১৪ দিনের মধ্যে ১৫০ মিটার এলাকায় দুই বা তার অধিক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়, তাহলে সেই ব্লককে ডেঙ্গু ক্লাস্টার হিসেবে ঘোষণা করা হয়, অধিবাসীদের সচেতন করার জন্য লাল বা হলুদ রঙের ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়। কোনো ক্লাস্টারে ১০–এর কম ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলে হলুদ ব্যানার এবং ১০–এর বেশি আক্রান্ত হলে লাল ব্যানার টানানো হয়। তা ছাড়া ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির ওয়েবসাইটেও ডেঙ্গু ক্লাস্টারের হালনাগাদ তথ্য থাকে যেন মানুষ সচেতন হতে পারে।

ডেঙ্গু মশার বৃদ্ধির ওপর নজর রাখার জন্য এনইএ গোটা সিঙ্গাপুরজুড়ে ৭০ হাজার গ্রেভিট্র্যাপ (ডিম পাড়তে ইচ্ছুক স্ত্রী এডিস মশা আটকানোর বিশেষ ফাঁদ) স্থাপন করেছে। এর ফাঁদের মধ্যে আটকানো মশার তথ্য থেকে এনইএ ধারণা করতে পারে কোনো কোনো এলাকায় এডিস মশার প্রাদুর্ভাব বেশি হচ্ছে, ফলে সীমিতসংখ্যক লোকবল দিয়ে কোথায় কোথায় অভিযান পরিচালনা করলে সবচেয়ে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে। তা ছাড়া এই ফাঁদের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশা মারা সম্ভব হয়।

আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সারা বছর নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম চালানো হয় না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্রেফ আগাম সতর্কতা জানিয়ে দায়িত্ব সারে, সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আগাম সতর্কতা পাওয়ার পরও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয় না, এমনকি যখন ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করে তখনো কিছু অনিয়মিত অভিযান ছাড়া আর তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ বোধ করে না।

ডেঙ্গু সব জায়গায় একবারে ছড়ায় না, কোনো কোনো অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। সময়মতো শুরুর দিকের ক্লাস্টারগুলোতে ডেঙ্গু দমনের যথাযথ পদক্ষেপ নিলে সারা শহর বা সারা দেশে সহজে ছড়াতে পারে না। কাজেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সারা বছর নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ঠিকানার মাধ্যমে এ ধরনের ডেঙ্গু ক্লাসটারগুলো শনাক্ত করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: [email protected]