সিডনির হত্যাযজ্ঞ গাজার কোনো গণহত্যাকে ঢাকতে পারবে না

গাজায় ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে ফিলিস্তিনি কিশোরেরা। গাজা নগরীর আল-শাতি শরণার্থীশিবিরের পাশেছবি: এএফপি

দুই খুনি যখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বন্ডি সমুদ্রসৈকতে গুলি চালিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করছিল, তখন গাজার খান ইউনিস সৈকতে এক নারী একটা ঝাড়ু নিয়ে সয়লাব হয়ে যাওয়া তাঁর তাঁবু থেকে পানি সরানোর চেষ্টা করছিলেন। এই তাঁবুটাকেই তিনি তাঁর ঘর বলে মেনে নিয়েছেন। এ সময় তিনি চিৎকার করে তাঁর বাচ্চাদের করুণ দশা দেখাচ্ছিলেন। ছিন্ন ও ভেজা পোশাকে বাচ্চাগুলো ঠান্ডায় বারবার শিউরে উঠছিল। কিন্তু না। কেউই তাঁর কথা শোনেনি। সারা দুনিয়ার নজর তখন সিডনি হত্যাযজ্ঞের দিকে।

পরের দিনগুলোয় সারা দুনিয়া ১৫ জন ইহুদিকে নৃশংসভাবে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের জন্য শোক প্রকাশ করতে থাকল। যা ঘটেছে তা সবাইকেই ভয়ার্ত করে তোলে। বন্ডি হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বৈশ্বিক শোক প্রাপ্য। কিন্তু এই যে শোক, তা তো একাধারে দ্বিচারিতা, প্রতারণামূলক ব্যবহার ও দ্বৈত নীতি দিয়ে ভরা। সবার প্রথমেই বলতে হয় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কথা, যিনি তড়িঘড়ি করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করলেন।

আরও পড়ুন

নেতানিয়াহু ব্যক্তিগতভাবে দায় নেওয়ার একটা বা দুটো বিষয় জানেন। আর তাই চট করে তিনি অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করলেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। তার মানে তিনি বোঝাতে চাইলেন যে এই হত্যাকাণ্ড ও ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে!

আসলে যেকোনো সন্ত্রাসী হামলা থেকেই রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ও প্রচারণা চালানোর কোনো সুযোগই ইসরায়েল কখনো হাতছাড়া করে না। এ রকম হামলা হতে পারে বলে মোসাদ যে একটা পূর্বাভাস দিয়েছিল, অস্ট্রেলিয়া তা উপেক্ষা করেছে—তাৎক্ষণিকভাবে এই তথ্যটাও ছড়িয়ে দেওয়া হলো। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এ রকম যে অস্ট্রেলীয়রা তো সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে জানে না, এমনকি তারা তা করতে চায়ও না! অথচ আমাদের [ইসরায়েলিদের] দিকে তাকালে তারা দেখত যে এখানে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়নি!

সিডনির বন্ডি সমুদ্রসৈকতে বন্দুক হামলা
ছবি: এএফপি

একজন ইসরায়েলি মন্ত্রী তো সিডনিতে উড়ে গেলেন নিহত ব্যক্তিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করতে। জেরুজালেম থেকে সিডনির দূরত্ব যত দ্রুত অতিক্রম করা গেল, তার চেয়ে শতগুণ কম দূর হওয়ার পরও জেরুজালেম থেকে নির ওজে কোনো সরকারি প্রতিনিধির দেখা মেলেনি গাজা যুদ্ধে নিহত নিজ দেশের নাগরিকদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। [২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় গাজা–সংলগ্ন নির ওজে সবচেয়ে বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছিল।] অথচ তাঁরাই আবার ‘কীভাবে অস্ট্রেলীয় সরকার ইহুদিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় একজন প্রতিনিধি না পাঠিয়ে থাকতে পারল?’ বলে উষ্মা প্রকাশ করছে। এহেন অতি স্পর্ধা তো সব সীমা অতিক্রম করে গেছে।

অবশ্য একটা কৌতুককর স্বস্তি নেমে আসে যখন জানা গেল যে একজন অস্ট্রেলীয়-সিরীয় কয়েকজন ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়েছে। নেতানিয়াহু তো ইহুদিদের বীরগাথা বর্ণনার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আহমদ আল আহমদ নামের ব্যক্তিটি সাহসিকতার সঙ্গে এক হত্যাকারীর বন্দুক কেড়ে নিয়ে তাকে নিরস্ত্র করে ফেলে—এই খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলিদের জন্য ‘বিব্রতকর’ হয়ে যায়। সব মুসলমান ও আরব সহজাতভাবেই খুনের জন্য অপরাধী—এহেন প্রচারণাও থেমে যায়।

আরও পড়ুন

এটা কি সম্ভব যে একজন আরব এ রকম সাহস ও মানবিকতা দেখিয়েছেন? কয়েক মুহূর্তের জন্য আরেকটা তাসের ঘর ধসে পড়ল। অবশ্য তার জায়গায় স্থান করে নিল ইহুদিবিদ্বেষ (অ্যান্টি-সেমিটিজম) নিয়ে বিতর্ক যদিও এটা খুব পরিষ্কার যে হত্যাকারীরা আইএসআইএসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর আইএসআইএসের লড়াই শুধু ইহুদিদের বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা পশ্চিমের বিরুদ্ধে।

এমনকি ইরানকে দায়ী করার চিরাচরিত প্রয়াসও তথ্যগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ হয়ে উঠল। ইরান ও আইএসআইএস পরস্পরের শত্রু। সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয় হলো হামলাকারীরা কেউই ফিলিস্তিনি নয়! সেটা হলেই তো কাজ সেরে যেত, জোর প্রচারণা ও ফায়দা লোটার মাত্রা অনেক বাড়ত।

তবে যাই হোক না কেন, এই ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ইসরায়েলি প্রচারণাকে সহায়তা করে, ইসরায়েলি ও ইহুদিদের বিপর্যয়ের একই পাত্রে ধারণ করে। সারা দুনিয়া যখন আমাদের বিরুদ্ধে তখন এভাবে একত্র হওয়াটা তো খুব ভালো বিষয়, নয় কি?

সর্বোপরি রয়েছে দ্বৈত মানে কালো মেঘ: সিডনির এক সৈকতে ১৫ জন মানুষের হত্যাকাণ্ড গাজার ভয়াবহ সব বড় বড় গণহত্যাগুলোকে ঝাপসা করে দিল। অথচ বন্ডি সৈকতে ছিল মাত্র দুজন হত্যাকারী। আর গাজায়? গোটা একটি দেশ ও তার সশস্ত্র বাহিনী এসব গণহত্যা চালিয়েছে, চালাচ্ছে। এইতো সেদিন, ১৮ জন শিশুসহ ৩৬ জন মানুষ মারা গেল গাজার বেইত হানাউনের এক স্কুলে ইসরায়েলি হামলায়। এ রকম আরও অনেক হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে, এমনকি কথিত যুদ্ধবিরতির মধ্যেও শত শত নিরীহ গাজাবাসী এখনো মারা পড়ছে।

না, বন্ডি সৈকতের হত্যাযজ্ঞ গাজা উপত্যকার সব গণহত্যাকে ঢেকে দিতে পারবে না। তবে ফিলিস্তিনিরা অশ্রুসজল চোখে কেবল দেখবে যে তাঁদের ধসে পড়া তাঁবুগুলো তাঁদের শীতার্ত বাতাসের চাবুক থেকে রক্ষা করতে পারেনি। বরং সারা দুনিয়া বন্ডি শোকে আক্রান্ত হয়ে তাঁদের কত দ্রুত ভুলে গেছে!

  • গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলের সাংবাদিক। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লিখে আসছেন।

হারেৎজ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ আসজাদুল কিবরিয়া