বিশ্লেষণ
তড়িঘড়ি করে ড্যাপের পরিবর্তন কার স্বার্থে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-২০৩৫ আবারও পরিবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তড়িঘড়ি করে কোনো সুনির্দিষ্ট গবেষণা ও তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ড্যাপের এই পরিবর্তন ঢাকার বসবাসযোগ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছে। তড়িঘড়ি করে ড্যাপের পরিবর্তন কার স্বার্থে তা নিয়ে লিখেছেন আকতার মাহমুদ, শায়ের গফুর, গীতি আরা নাসরীন, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, খন্দকার নিয়াজ রহমান, আদিল মুহাম্মদ খান, পাভেল পার্থ, ফিরোজ আহমেদ, আমিরুল রাজিব, নাঈম উল হাসান এবং সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন
ঢাকার অধিকাংশ সাধারণ নাগরিকের দিন শুরু হয় একটি আলো-বাতাসবিহীন এবং পথচারী চলাচলের সুবিধাহীন সরু গলিতে। গলিপথ থেকে প্রধান রাস্তায় ওঠামাত্র আমাদের সম্মুখীন হতে হয় ঢাকার কুখ্যাত গণপরিবহনব্যবস্থা ও ট্রাফিক জ্যামের।
এই শহর যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রতিটি দিনই যেন একটি যুদ্ধ। জনবিরোধী ও পরিবেশ বিধ্বংসী নানা অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকার যে শোচনীয় অবস্থা তাতে এই শহরে মানুষ ও প্রাণিকুলের টিকে থাকার ন্যূনতম কোনো মানদণ্ড বজায় থাকেনি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে অর্থনীতির সীমাহীন প্রবৃদ্ধির যে ধারণা পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা রাষ্ট্রের নীতিমালা এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এখনো সেই ধারণার বাইরে চিন্তা করতে পারছেন না।
আনুমানিক আড়াই কোটি জনসংখ্যার রাজধানী ঢাকা দেশের জিডিপিতে প্রায় ৪০ ভাগ অবদান রাখে। শহরের সর্বস্তরে অপরিকল্পিত নগরায়ণের মূল্য চুকাতে হয়েছে পরিবেশ বিসর্জন ও বাসযোগ্যতা হারানোর মধ্য দিয়ে। রাজধানী হিসেবে ঢাকা দেশের অন্যান্য শহরের জন্য একটি আদর্শ নগর হিসেবে বেড়ে ওঠার কথা।
কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখতে পাই যে স্থানীয় অবকাঠামো, জীবনযাত্রা এবং বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাবের কথা চিন্তা না করেই ঢাকাকেন্দ্রিক নীতিমালা এবং বিধ্বংসী পরিকল্পনার নানা দিকগুলো দেশের অন্যান্য অংশে নানাভাবে অনুকরণ ও অনুসরণ করা হচ্ছে।
ঢাকা কি আদতে দেশের অন্যান্য শহরের জন্য আদর্শ হওয়ার যোগ্যতা রাখে? ২০২৫ সালে ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় সর্বনিম্ন বাসযোগ্য শহর হিসেবে নির্বাচিত হয়, যেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর ত্রিপলি আর দামাস্কাস। এই র্যাঙ্কিং আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হওয়া উচিত ছিল।
২.
এই শহরের মানুষের জীবনকে সহনীয় করে তোলার জন্য এবং প্রায় অকার্যকর শহরটিকে ঠিক করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু মৌলিক জনবান্ধব টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে একটি কার্যকর ও টেকসই পরিকল্পনা নীতিমালা সামনে আনার পরিবর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০২২-২০৩৫ আবারও পরিবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে!
বহুবছর কোনো পরিকল্পিত উন্নয়ন ছাড়া বেড়ে ওঠার পর, ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ (ড্যাপ) দেশের নগর–পরিকল্পনায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। দীর্ঘ গবেষণা, অসংখ্য সভা এবং পরামর্শের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের একটি দল এবং রাজউক ড্যাপ প্রণয়ন করে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঢাকা শহরকে দুর্দশামুক্ত করতে ড্যাপ প্রণয়ন একটি সঠিক ও জরুরি পদক্ষেপ ছিল।
ঢাকার সব এলাকার জন্য একই উন্নয়ন পদ্ধতি গ্রহণের পরিবর্তে শহরটিকে ৩৫০টি জনঘনত্বের অঞ্চলে বিভক্ত করে নাগরিক ও সামাজিক সুবিধা বিবেচনাপূর্বক একটি স্থানিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই অঞ্চলগুলোর রাস্তার অবস্থা, নাগরিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং এলাকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মতো বিদ্যমান অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ভবনের উচ্চতা, ভূমি আচ্ছাদন এবং ইউনিটসংখ্যা নির্ধারণ করেছিল।
কিন্তু ড্যাপের গেজেট প্রকাশের এক বছরের মধ্যেই রাজউক আবাসন ব্যবসায়ী এবং কতিপয় জমির মালিকদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বেশ কিছু এলাকার ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) বৃদ্ধি করে।
ফ্লোর এরিয়া রেশিও আবাসন ব্যবসায়ী এবং নির্মাণসংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের (স্থপতি, প্রকৌশলী, ইত্যাদি) জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি একটি প্লটে নির্মিতব্য বিল্ডিংয়ের আনুপাতিক আয়তন এবং মেঝের ক্ষেত্রফল নির্ধারণ করে। ফার যত বেশি একটি জমিতে তত বড় আয়তনের বিল্ডিং তৈরি করা যায় এবং যত বড় বিল্ডিং তত বেশি মুনাফা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ফার ও উচ্চতাসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে একই আয়তনের প্লটে ৬ তলা বিল্ডিংয়ের জায়গায় ৮-১০ তলা বিল্ডিং নির্মাণ করার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সে এলাকায় রাস্তা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, খেলার মাঠ, পার্ক ও স্কুলসহ অন্যান্য নাগরিক ব্যবস্থা এই বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ নিতে পারবে কি না, সে বিষয়ে কোনো অর্থপূর্ণ গবেষণা না করে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানে হচ্ছে সেই এলাকার নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা ও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া।
দেশে-বিদেশে সরকার এবং নগর–পরিকল্পনাবিদেরা শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য অবকাঠামো এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে এলাকার জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য ফার ব্যবহার করে। ঢাকা জনঘনত্বের দিক থেকে অনেক আগেই সব ধরনের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাজউকের ড্যাপ বাস্তবায়নে আগ্রহ বা সক্ষমতা আছে কি না, প্রশ্ন করা যেতেই পারে, কিন্তু এই প্ল্যান সত্যিকার অর্থেই জনগণ এবং সরকারকে সুযোগ দিয়েছিল ভালো কিছু করার। সে জায়গা থেকে ঢাকা শহরের টেকসই উন্নয়নের জন্য এই ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জারি রাখা জরুরি প্রয়োজন ছিল।
৩.
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে। যার ফলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয় এবং এসব কমিশন প্রণীত প্রতিবেদনসমূহ সংস্কারকাজের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করার কথা।
কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) চাপে সরকার কোনো ধরনের কমিশন গঠন বা বিশেষজ্ঞ তত্ত্বাবধান ছাড়াই ড্যাপ পরিবর্তনের উদ্যোগ নিল।
পরিবেশ ও নাগরিক অধিকারকর্মী, শিক্ষাবিদ, পরিকল্পনাবিদ, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন স্থপতিও ছিলেন, তাঁদের সবার নানা উদ্যোগ ও আবেদন উপেক্ষা করে সরকার ড্যাপের জনঘনত্ব অঞ্চলের সংখ্যা ৩৫০ থেকে একীভূত করে ৬৫ অঞ্চলে নামিয়ে আনে।
এই প্রক্রিয়াতে ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ফার বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়। বিদ্যমান ড্যাপে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পরিকল্পনাটি সংশোধন করার বিধান ছিল, কিন্তু সরকার কোনো ধরনের গবেষণা ও যুক্তি ছাড়াই এই গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাটি ইতিমধ্যেই দুইবার পরিবর্তন করে ফেলেছে।
এটা মনে রাখা দরকার যে তড়িঘড়ি করে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত শুধু কয়েকটি বিল্ডিং বা এলাকাকেই নয় বরং এই সিদ্ধান্ত সমগ্র ঢাকার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পয়োনিষ্কাশন হতে শুরু করে পরিবহনব্যবস্থাসহ শিক্ষা, চিকিৎসার মতো নাগরিক সুবিধাসমূহের ওপরও দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
প্রশ্ন হলো সংস্কার কর্মসূচিতে না থাকার পরও পুরো ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তড়িঘড়ি করে ড্যাপের মতো একটি অতি সংবেদনশীল প্ল্যান পরিবর্তন করতে এত আগ্রহী হয়ে উঠেছে কার স্বার্থে?
ফার সংশোধনের জন্য রিহ্যাব ও অন্যান্যরা যেসব যুক্তি পেশ করেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল যে ইউনিটের সংখ্যা সীমিত করলে ফ্ল্যাটের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে আবাসন খাতে কালোটাকা বৈধ করার বিধান দেশের আবাসন খাতের বাজারকে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে, যদিও তারা ঢাকার নাগরিকদের সর্ববৃহৎ অংশ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এই অন্যায্য বিধান বন্ধ করার পরিবর্তে নানা ফাঁকফোকরের মাধ্যমে আবাসন খাতে কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়া জারি রেখেছে এবং একই সঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ীদের ড্যাপ পরিবর্তনের দাবি মেনে নিয়েছে।
৪.
আবাসন ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের আরেকটি যুক্তি হলো যে বিদ্যমান ড্যাপের জনঘনত্বের অঞ্চল অনুসারে প্রদত্ত ফার ‘বৈষম্যমূলক’ কারণ অবস্থাপন্ন অঞ্চলগুলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি ফার পেয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কমাতে সেই অঞ্চলগুলোতে ফার কমানোর দাবির পরিবর্তে তারা সংকীর্ণ রাস্তা এবং অপ্রতুল ও দুর্বল নাগরিক পরিষেবা এবং ব্যবস্থাপনাপূর্ণ এলাকায় ফার বৃদ্ধির দাবি জানায়, যা জনবিরোধী, সম্পূর্ণরূপে মুনাফালোভী মানসিকতা এবং যেকোনো পরিকল্পনা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ঢাকার কত অংশের উন্নয়নকাজের সঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ীরা জড়িত যে তারা পুরো ঢাকার বাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে?
তড়িঘড়ি করে কোনো সুনির্দিষ্ট গবেষণা ও তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ড্যাপের এই পরিবর্তন ঢাকার বসবাসযোগ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছে। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ না নিয়ে, সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যা ভবিষ্যতে এই নগরের জন্য অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় বয়ে আনবে।
আমাদের বর্তমান নীতিনির্ধারকদের চিন্তা করা উচিত ছিল যে তাদের কিংবা আগত নির্বাচিত সরকারের ঢাকার মানুষের জন্য নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করার মতো অবকাঠামোগত উন্নয়নের সক্ষমতা আছে কি না।
ক্রমাগত অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো এবং জরুরি পরিষেবার অপ্রতুলতা ও দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পে ঢাকার প্রস্তুতির অভাব সম্পর্কে বারবার সতর্ক করে চলেছেন।
বর্ধিত কলেবরে ভবন নির্মাণ এবং মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্বের সঙ্গে যে সামগ্রিক ঝুঁকি বৃদ্ধি হতে যাচ্ছে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় ড্যাপের এই পরিবর্তন বাসযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকার সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেক হতে পারে।
লেখকেরা পরিবেশকর্মী, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, আইনজীবী, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
মতামত লেখকদের নিজস্ব