ঢাকার মতো বিশাল একটি শহরের সব এলাকার জন্য একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সব অপরিকল্পিত এলাকার পরিকল্পনা করা উচিত; বিশেষ করে যেসব শহর অগোছালোভাবে বেড়ে ওঠা ও ভরাটকৃত এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে এবং যেখানে অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদি ছাড়াই শহুরে ব্যবস্থা প্রসারিত হচ্ছে।
যতই প্রতিরোধকারী নিয়ম ও প্রবিধান থাকুক না কেন, এ ধরনের এলাকাগুলো অনিবার্যভাবে শহুরে কাজে ব্যবহৃত হবে। দুর্ভাগ্যবশত, সাম্প্রতিক ড্যাপে এসব অনানুষ্ঠানিক এলাকার জন্য কোনো বিশদ পরিকল্পনা নেই। এই ড্যাপে ১৮টি কেন্দ্রীয় উপ-অঞ্চল এবং ৮টি বর্ধিঞ্চু উপ-অঞ্চল রয়েছে। বর্ধিঞ্চু উপ-অঞ্চলগুলোয় অনুমতিযোগ্য উন্নয়নের ধরন, নাগরিক সুবিধার অবস্থান এবং ভবিষ্যতের রাস্তাগুলোর পথনির্দেশনার বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা উচিত। এটি এমনকি সব পরিকল্পিত এলাকার পরিকল্পনাও করতে পারে, যার বর্তমান ব্যবহার বহুমুখী হয়ে উঠেছে অথবা তেজগাঁও বা মতিঝিল এলাকার মতো অননুমোদিত ব্যবহার হচ্ছে।
ড্যাপে অনেক নীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে স্বল্প সংখ্যায় বাড়ি বানানোর অনুমতি দিয়ে জনঘনত্ব হ্রাস করা এবং এভাবে ঢাকামুখী অভিবাসন বন্ধ করা। এ নীতির ভিত্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, ঢাকার জনসংখ্যা ২০৩৫ সালে ২ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছাবে এবং নগর কর্তৃপক্ষের এ মাত্রার ভৌত সুবিধাদি সরবরাহ করার ক্ষমতা নেই, যার কোনোটিই যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
অনেক নগর-পরিকল্পনা তত্ত্বই শহুরে ঘনত্ব বাড়ানোর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যেমন নতুন নগরবাদ, ট্রানজিট-ভিত্তিক উন্নয়ন এবং চৌকস বৃদ্ধি; নতুন ড্যাপে সব কটি কৌশলই বিবেচনা করা হয়েছে কেবল ঘনত্ব ছাড়া। ঘনকরণ (ডেনসিফিকেশন) একটি টেকসই কৌশল, যা কী পরিমাণ ভূমি ব্যবহৃত হবে, তা নির্দিষ্ট করে। সাধারণত দাবি করা হয় যে ঘনবসতির শহরগুলো অন্যগুলোর তুলনায় বেশি টেকসই।
টেকসই নগরবাদ বিশেষজ্ঞ জ্যা গেহল যুক্তি দেন, কম ঘনত্বের বিস্তৃত গাড়িনির্ভর শহরগুলো টেকসই নয়। একটি নিবিড় শহর বিভিন্ন এলাকার মধ্যে চলাচলকে আরও পরিমিত করে তোলে। এ সুবিধা পাওয়ার জন্য, ঘনত্ব বৃদ্ধিকে অনেক দেশে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনায় কৌশল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেই সঙ্গে এসডিজি লক্ষ্য ১১-তেও তা আছে। উন্নত এবং অনেক স্বল্পোন্নত দেশ এখন নিবিড় নগররূপ অনুসরণ করে। বিভিন্ন গবেষণা নিবিড়তার গৌণ সুবিধাগুলো তুলে ধরেছে, যেমন উচ্চ উৎপাদনশীলতা; কম খরচে পরিষেবা; আর্থসামাজিক গতিশীলতা এবং বৈচিত্র্য; পরিবহন ব্যবহার বৃদ্ধি; জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার; দূষণ কমানো এবং উন্নত স্বাস্থ্য ও সুস্থতা। মনে আছে কোভিড-১৯ বড় শহরগুলোতেই বেড়েছে, ঢাকার মতো ঘন শহরে নয়! নাসার গবেষণায় শহুরে ঘনত্ব, জ্বালানি খরচ এবং বায়ুদূষণের মধ্যে সম্পর্ক দেখা যায়।
ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও), যা ইমারত ঘনত্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পরিমাপ এবং একক এলাকায় বাড়ির সংখ্যা—এ দুটিকে ভূ-আচ্ছাদন, বাড়ির আকার, পরিবারের সদস্যসংখ্যা, আবাসিক ঘনত্ব, কর্মসংস্থানের মতো অন্যান্য অনেক নির্দেশকের সঙ্গে একত্রে দেখতে হবে। একই ফারের আওতায়, নিম্ন ঘনত্বওয়ালা বহুতল ভবন বা উচ্চ ঘনত্বওয়ালা নিচুতলার ভবন তৈরি করা সম্ভব।
ভবনের উচ্চতা ঘনত্বের একটি পরিমাপ নয়, যদিও কখনো কখনো দুটি মিলে যায়। বিভ্রান্তি এখানে প্রচুর; ড্যাপ ফারকে উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মিলিয়েছে এবং প্রতি একরে বাড়ির সংখ্যাকে ব্যবহার করছে, যা ঘনত্বের একটি ক্রূর পরিমাপ; এটা জনসংখ্যা বা ভবনঘনত্বের নির্ণায়ক নয় (বাসস্থান এবং পরিবারের আকার নির্দিষ্ট করা ব্যতিরেকে)। এতে করে এই দুই পদক্ষেপের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে।
স্থপতিরা যখন ফার ঘিরে তাঁদের যুক্তিগুলো তুলছেন, ড্যাপ পরেরটিতে নির্ভর করছে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৮১ এবং ১৯৯৫—উভয় মহাপরিকল্পনাতেই ঢাকার জনঘনত্ব বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কারণ, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে বিদ্যমান অবকাঠামো দ্বারাই আরও বেশি লোককে নির্মিত এলাকার ভেতরই স্থান দেওয়া যেত।
ঘনত্ব পরিমাপ করার অনেক উপায় আছে। শহুরে ঘনত্ব পুরো শহরের পদচিহ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ধরা হয় কেবল আবাসিক এলাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে। যদিও এটি শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাধন করা যাবে কি না, সে ধারণা দেয়; তবে একই ঘনত্ব বিভিন্ন প্রেক্ষিত তৈরি করতে পারে। এভাবে এটি যতটা না বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও পরিস্থিতির ধারণা দেয়, তার চেয়ে বেশি লুকিয়ে রাখে। যেমন অতিরিক্ত ভিড়, উচ্চ ভূ-আচ্ছাদন, স্বল্প ভূ-আচ্ছাদনসহ বড় অ্যাপার্টমেন্ট, জনহীন শহর এবং স্বল্প অনুপাতের আবাসিক ব্যবহার।
ঢাকার মতো জায়গা ও বাসস্থান সংকটাপন্ন শহরের জন্য এগুলোর কোনোটাই সমর্থনযোগ্য নয়। বর্তমান ড্যাপ বিতর্কে, ‘ঘনত্ব’ বলতে কী বোঝায়, তা অনুপস্থিত। এটা কি আয়তন, ভবনের উচ্চতা, নাকি মানুষের সংখ্যা? একজনের কাছে যা উচ্চ ঘনত্ব, আরেকজনের কাছে তা বিস্তৃতি হতে পারে; একই বহুতল ভবন ভীতিকর বা আনন্দদায়ক হতে পারে।
একজনের জন্য একটি আনন্দদায়ক সমাবেশ, অন্যের জন্য অতিরিক্ত ভিড় বলে বিবেচিত হতে পারে। জনসংখ্যার ঘনত্ব শুধু আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে করা যায় না। কারণ, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি আবাসিক এলাকায় যাঁরা সেখানে কাজ করেন বা ভ্রমণে এসেছেন তাঁরাও থাকেন। কাজের সময় এক রকম ঘনত্ব তৈরি হয়, আবার সপ্তাহান্তে তা খালি থাকে। ঘনত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং মিশ্র ব্যবহারের পাড়ায়, যেখানে বাসিন্দারা জনসংখ্যার একটি লঘিষ্ঠ অনুপাতমাত্র, ওঠানামা করে। ঘনত্বের ভেতর ছন্দও আছে, কারণ, মানুষ সব সময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করে।
শহরগুলো কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য শহুরে ঘনত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। শহুরে ঘনত্বের বিপুলসংখ্যক অর্থনৈতিক ফলাফলের ওপর ১৮০টি গবেষণার একটি ২০১৯ সালের মেটা-বিশ্লেষণ এর সামগ্রিক ইতিবাচক প্রভাব দেখিয়েছে। একটি ২০২০ সমীক্ষার উপসংহারে এসেছে, শহুরে ঘনত্ব উৎপাদনশীলতা এবং উদ্ভাবন বাড়িয়ে দেয়, পণ্য ও পরিষেবাগুলোয় প্রবেশগম্যতার উন্নয়ন করে, সাধারণ ভ্রমণদূরত্ব হ্রাস করে, জ্বালানিসাশ্রয়ী নির্মাণ এবং পরিবহনকে উৎসাহিত করে এবং দুষ্প্রাপ্য শহুরে সুযোগ-সুবিধাগুলো ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ দেয়।
রাস্তার জীবনঘনত্বের জটিলতাও রয়েছে (উন্মুক্ত স্থান বা জনসমাগম) এবং যা প্রাপ্য চাকরি এবং ভ্রমণকারীর সংখ্যা, কার্যকর মিশ্রণ, গাড়িনির্ভরতা, প্রবেশগম্যতা, হাঁটার ক্ষমতা ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এখানেই ঘনত্ব সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই, অনেক নগর-পরিকল্পনাবিদ উচ্চ ঘনত্ব সৃষ্টির পরামর্শ দেন, কারণ নগরবাসী যখন কাছাকাছি বাস করে, তখন শহরগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে চালানো যায়। ঘন শহরগুলোয় হাঁটা যায় এবং নানাবিধ পরিবহনের বিকল্প সুযোগও রয়েছে।
যা হোক, ‘চৌকস প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনা’এর কোনো সুবিধা ছাড়াই বিস্তৃতির মাধ্যমে শহরগুলো টেকসই হয়ে ওঠে না। টেকসই করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশক বা অস্ত্র রয়েছে নগর-পরিকল্পনাবিদদের কাছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মানুষ কীভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং জীবনযাত্রার মান। যদি গাড়ি হয় তাদের চলাফেরার প্রাথমিক মাধ্যম, তবে তা টেকসই নয়। এটি রাস্তানির্ভর উন্নয়ন, আর্থিকভাবে সীমাবদ্ধ পৌরসভা পরিষেবার প্রসারণ (নিবিড়, বহু ব্যবহারিক নির্মিতি থেকে বেশি পরিমাণ রাজস্বপ্রাপ্তির বিপরীতে) এবং বায়ুদূষণ বৃদ্ধির দ্বারা বিশেষায়িত বিস্তৃতি তৈরি করে।
‘চৌকস প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনা’এর কোনো সুবিধা ছাড়াই বিস্তৃতির মাধ্যমে শহরগুলো টেকসই হয়ে ওঠে না। টেকসই করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশক বা অস্ত্র রয়েছে নগর-পরিকল্পনাবিদদের কাছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মানুষ কীভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং জীবনযাত্রার মান। যদি গাড়ি হয় তাদের চলাফেরার প্রাথমিক মাধ্যম, তবে তা টেকসই নয়।
ড্যাপ দর্শনের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি, ঘনত্ব কমানো মানুষের কখনোই শহরে আসা থামাতে পারবে না। বরং এটি ঘিঞ্জি বস্তি সৃষ্টিতে এবং আরও অধিক হারে জলাভূমি ভরাটকে উৎসাহিত করবে; এ বিষয়ে আজতক বিশ্বে যত লেখালেখি হয়েছে, সবই তা নির্দেশ করে। শহরমুখী জনগণ বিভিন্ন কারণে শহরে আসে, তার ভেতর প্রধান হচ্ছে অর্থনৈতিক। তাদের অধিকাংশেরই আশ্রয় হয় বস্তিতে।
যাতে এত অধিক লোকের বড় শহরগুলোয় আসতে না হয়, তেমন পরিস্থিতি তৈরি করা ড্যাপ বা এমনকি কাঠামো পরিকল্পনার আওতা বা ক্ষমতার বাইরে। কেবল একটি সুষ্ঠু জাতীয় আর্থসামাজিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই তা অর্জন করা যাবে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী ঢাকায় ২০৩৫ সালের মধ্যে ৩ কোটির বেশি মানুষ বাস করবে। এর সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা যোগ করুন। দক্ষিণ বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পৃথিবীতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তত দিনে ঢাকায় আরও অতিরিক্ত বিশ-ত্রিশ লাখ নিঃস্ব মানুষ চলে আসবে।
নিম্ন আয়ের বসতিগুলোয় এক বৃহৎসংখ্যক নগরবাসী যে শোচনীয় এবং অমানবিক জীবন পালন করে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যা হোক, আমরা এ ব্যাপক সমস্যার মানবিক সমাধান না দিয়ে এবং যে কারণে এ ধরনের অবক্ষয় ঘটে, তা নির্মূল না করে বস্তিবাসীদের অপসারণ করতে পারি না। দুর্ভাগ্যবশত, ড্যাপ এমনকি বস্তি শব্দটিকেও ‘বিতর্কিত’ বলে এ ব্যাপারে কথা বলতে অস্বীকার করেছে; ড্যাপ বরং আশা করে যে আপনাআপনিই (প্রণোদনার ভিত্তিতে) ‘সাশ্রয়ী আবাসন’ গড়ে উঠবে। তবে প্রশ্ন হলো, কার সাধ্যের মধ্যে হবে তা? এ ব্যাপারে পাঠকেরা মনে করতে পারেন, কীভাবে ভাসানটেক প্রকল্পটি উচ্চতর আয়ের গোষ্ঠীর কাছে হাতছাড়া হয়ে গেছে।
বলা হচ্ছে, ঘনত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিটি এলাকার সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে; সুবিধাগুলো কি শুধুই পার্ক আর স্কুল? এ তো হওয়া উচিত ন্যূনতম পরিষেবার ভিত্তিতে; তার তথ্য-উপাত্ত কই?
মোদ্দাকথা, ঢাকার জনসংখ্যা সীমিত করার চিন্তা কেবল বাংলাদেশের শহুরে দৃশ্যকল্পেই নয়, এক বিশাল জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপরও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে। আমরা যত তাড়াতাড়ি তা বুঝতে পেরে সঠিক সিদ্ধান্ত নেব, ততই বাংলাদেশের মঙ্গল হবে।
মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান স্থপতি, নগর-পরিকল্পনাবিদ এবং আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সহ-উপাচার্য।