গরুর মাংসের দাম বাড়াবেনই যখন, তখন কদিনের জন্য কমালেন কেন

গরুর মাংসের দাম নির্বাচনের আগে কিছুদিনের জন্য সহনীয় থাকায় অনেকে ভিড় করে মাছ, মাংস কিনছিলেনফাইল ছবি

মাস দুয়েক আগে, কথা নেই বার্তা নেই, গরুর মাংসের দাম হঠাৎ একলাফে কেজিতে ১০০ টাকার বেশি কমে গেল। চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। কীভাবে, কোন জাদুস্পর্শে রাতারাতি দাম কমে গেল, তা নিয়ে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলল নানা আলোচনা। অনেকে প্রশ্ন তুললেন, এত দিন তাহলে এভাবে মানুষকে ঠকানো হলো কেন? নানাজনে নানা বিশ্লেষণ হাজির করলেন। কেউ কেউ ব্যবসায়ীর দিকে আঙুল তুললেন। বললেন, চর্বি, হাড়, মাথা—সব একসঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করায় দাম কমেছে। এটা কৃত্রিমভাবে দাম কমানো।

এত দিন আমরা সবাই কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর কথা শুনে এসেছি। এই প্রথম কৃত্রিমভাবে দাম কমানোর কথা শুনল আমজনতা। যা-ই হোক, এই কৃত্রিম কারসাজির ব্যাপারটা নিয়ে আমজনতার মাথা ঘামানোর দরকার হয়নি। অনেক দিন পর সন্তানের পাতে গরুর মাংস তুলে দিতে পাওয়ার আশায় তাঁরা মাংসের দোকানে ভিড় করেছেন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বাজারের থলিতে মাংস নিয়ে ফিরেছেন।

গরুর মাংসের দাম কমার প্রভাব সামগ্রিকভাবে প্রোটিনের বাজারেও পড়েছিল। মাছ, মাংস, মুরগি ও ডিমের দামও কিছুটা কমে এসেছিল। ফলে একটা বিরাটসংখ্যক মানুষ বাজারে গিয়ে প্রোটিন কিনতে পারছিলেন। অবশ্য ঠোঁটকাটা স্বভাবের নিন্দুক যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ বলতে ছাড়েননি, রোসো, নির্বাচনটা যাক। তারপর কড়ায়-গন্ডায় পুষিয়ে নেবে। এখন তো মনে হচ্ছে, নিন্দুকদের সেই কথাই সত্যি হলো। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হতে না হতেই গরুর মাংসের বাজার চড়তে শুরু করল।

ঢাকার বাজারে গরুর মাংসের দাম আবার ৭০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। একটু ভালো মানের মাংস কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে আরও বেশি। এই দাম বাড়ার প্রভাব প্রোটিনের বাজারে পড়েছে। মুরগি, মাছ—সবকিছুর দামেই তেজি ভাব। আর সেই সঙ্গে এবারের শীত মৌসুমে অবিশ্বাস্যভাবে সবজির চড়া দাম যুক্ত হয়েছে। নতুন বছরের শুরুতেই চালের দামেও বড় ধাক্কা। চালের সঙ্গে বছরের শুরুতেই ১৩টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বাড়িভাড়ার বড় ধাক্কা তো আছেই। এর সঙ্গে আবার নতুন করে চলছে গ্যাসের চুলার দাম বাড়ানোর উদ্যোগ।

বাজারের সূত্র অনুযায়ী, দাম কম থাকলে বিক্রি বাড়ে। দাম বেশি থাকলে বিক্রি কমে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যদি অতি মুনাফা করার সুযোগ পান, তাহলে সমাজের ওপরের স্তরের কিছু মানুষের কেনার ক্ষমতা থাকলেও বেশির ভাগ মানুষকে বাজার থেকে শূন্য হাতেই ফিরতে হয়। গত কয়েক বছরের মতো এবারও পবিত্র রমজানের অনেক আগে থেকেই অতি মুনাফা করার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেল কি?

এ পরিস্থিতিতে সীমিত আয়ের মানুষ আর কত জুতার মাপে পা কেটে কেটে জীবন চালাবেন? এই ধাক্কা শুরু হয়েছিল করোনা মহামারি থেকেই। আর দুই বছর ধরে নীরব ঘাতক উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলাতে সামলাতে তাঁদের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। আওয়ামী লীগ এবারের ইশতেহারে জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালে আনার অঙ্গীকার করেছে। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নয়, জনস্বার্থে কাজ করার কথা বলেছেন। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতে বাজার ও খরচের বহরের যে তেজি ভাব, তাতে মানুষের আশ্বস্ত হওয়ার মতো কারণ আছে কি?

বাজারের পাগলা ঘোড়া যেসব মোক্ষম দাওয়াইয়ে বশে থাকে, তার কোনোটিই বাস্তবে উপস্থিত নেই। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা যা বলছেন, তাতে চরম আশাবাদীর পক্ষেও আশাবাদী হওয়ার কোনো উপায় নেই। তাঁরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। তার কারণ তিনটি। 

প্রথমত, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমানো দরকার। দ্বিতীয়ত, আমদানি বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো দরকার; কিন্তু ডলারের সংকটে ব্যবসায়ীরা সহজে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। ডলারের বাড়তি দামের কারণেও খরচ বেড়েছে। তৃতীয়ত, কিছু কিছু পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে। সেখানেও ছাড় দেওয়া সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কারণ, সরকার রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে। (প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪)

এই তিনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাজারের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, যা পরিস্থিতি আরও দুর্বিষহ করে তুলছে। বাজারে যে কতভাবে কারসাজি করা সম্ভব, তার বাস্তব উদাহরণ গরুর মাংসের দামের তেলেসমাতি কারবার। স্বাভাবিক কোনো কারণেই নির্বাচনের দেড় মাস আগে মাংসের দাম রাতারাতি ১০০ টাকা কমতে পারে না। আবার নির্বাচনের পরের দিনই একলাফে ১০০ টাকা বাড়তে পারে না। 

সমকাল-এর খবর বলছে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হওয়া এবং নানা মহলের চাপে মাংস ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে বিক্রি করেছিলেন। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাংসের উৎপাদন আগের অর্থবছরের তুলনায় পাঁচ লাখ টন কম হয়েছে। এরপরও কাগজে-কলমে মাংসের যে বার্ষিক চাহিদা (৭৬ লাখ টন), তার চেয়ে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হয়েছে। তাহলে কেন দাম বাড়ল?

ব্যবসায়ীদের যুক্তির অবশ্য কমতি নেই। তাঁরা বলছেন, অনেকে কোরবানির জন্য গরু মজুত করেছেন, কম দামে তাঁরা গরু পাচ্ছেন না। তাঁদের যুক্তি যদি স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিই, তাহলে এই যুক্তিও এসে যায়, সব খামারি কি একযোগে এক রাতেই গরু মজুতের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? অবশ্য উৎপাদক বা খামারিরা কিন্তু ভিন্ন কথাই বলছেন। তাঁরা বলছেন, এক মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম এতটা বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এ সময়ের মধ্যে উৎপাদন খরচ বাড়েনি। আবার সরবরাহের বড় সংকট তৈরি হয়েছে, তা-ও নয়।

বাজারের সূত্র অনুযায়ী, দাম কম থাকলে বিক্রি বাড়ে। দাম বেশি থাকলে বিক্রি কমে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যদি অতি মুনাফা করার সুযোগ পান, তাহলে সমাজের ওপরের স্তরের কিছু মানুষের কেনার ক্ষমতা থাকলেও বেশির ভাগ মানুষকে বাজার থেকে শূন্য হাতেই ফিরতে হয়। গত কয়েক বছরের মতো এবারও পবিত্র রমজানের অনেক আগে থেকেই অতি মুনাফা করার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেল কি?

মনোজ দেপ্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী