১৯৭১ নিয়ে পুনঃকল্পনা : নতুন সময়ে পুরোনো সম্ভাবনা

১৯৭১-কে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ ও তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে জাতিগত ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র ‘ঐতিহ্য’ই হুমকির মুখে পড়েছে। ১৯৭১ নিয়ে পুনঃকল্পনা এবং সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছেন মুশাহিদ হুসেন

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। রবার্ট এডওয়ার্ডস সাধারণত ভবিষ্যদ্বাণীমূলক আশঙ্কায় ভোগা মানুষ ছিলেন না। কিন্তু নিউইয়র্কে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সদর দপ্তরে পাঠানো তাঁর এপ্রিল মাসের বার্তায় একধরনের দূরদর্শী সুর ছিল, যা কয়েক দিন আগেই ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটের কর্মকর্তাদের সতর্কবার্তার প্রতিধ্বনি করছিল।

হার্ভার্ড-প্রশিক্ষিত আইনজীবী এবং আফ্রিকায় কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এডওয়ার্ডস ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যামূলক অভিযানের সূচনার পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে তাঁর কাছে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল: ‘আমরা মনে করি, কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনী যারা এখনো পৃথক সত্তা—একটি অন্ধগলিতে ঢুকে পড়েছে এবং তারা এখনো এই বাস্তবতা স্বীকার করেনি যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলা চিরতরে হারিয়ে গেছে…একবার জেগে ওঠার পর বাংলাকে পুরোপুরি দমন করা সম্ভব নয় বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

মাত্র এক মাস আগেই শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রাষ্ট্রবিরোধী সহিংসতার আশঙ্কা বাড়তে থাকায় এডওয়ার্ডস গুরুত্বের সঙ্গে ভেবেছিলেন, ‘সেনাবাহিনী আবারও বাংলাকে তার নিজের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।’ কিন্তু এপ্রিলের শুরুতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ‘অভূতপূর্ব নৃশংসতা’ সেই ধারণাকে চূড়ান্তভাবে খারিজ করে দেয়।

আরও পড়ুন

স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সামরিক নয়, রাজনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ এবং মুজিবই ‘যুক্তিবাদী, চুক্তিভিত্তিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একমাত্র ক্ষীণ সম্ভাবনা’র প্রতিনিধিত্ব করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঐক্যবদ্ধ করার শক্তি স্বীকার করলেও এডওয়ার্ডস এর বিপ্লবী সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন; তাঁর কাছে এটি এমন এক ‘বিশৃঙ্খলা’র শক্তি বলে মনে হয়েছিল, যা হয়তো মুজিব নিজেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না।

পরবর্তী কয়েক মাসে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। কারণ, ক্রমবিকাশমান ‘পূর্ব পাকিস্তান সংকট’ একটি গভীরতর সমস্যার প্রতীক হয়ে ওঠে: পুনর্বণ্টন ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রীকরণের বদলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি—যা আইয়ুব খানের দশকজুড়ে শাসনামলে এডওয়ার্ডসের মতো রাষ্ট্রনির্মাতা ও আধুনিকীকরণবাদীরা উৎসাহিত করেছিলেন।

ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ইউজিন স্ট্যাপলস একসময় ‘পশ্চিমা রুচির কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় নেতা’ বলে আইয়ুব খানকে প্রশংসা করেছিলেন; সে ধরনের ‘মৃদু স্বৈরতন্ত্রের’ প্রশস্তি ১৯৭১ সালের এপ্রিলে এসে কেবল বেমানানই নয়, রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং নৈতিকভাবে অগ্রহণীয় হয়ে পড়ে।

১৯৭১ সালের বিপ্লবী মুহূর্ত (একাত্তর) ‘উন্নয়ন সমস্যা’ সম্পর্কে বৈশ্বিক ধারণায় একটি রূপান্তরের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে, যা ১৯৫০-এর দশক থেকে ক্রমে প্রাধান্য পাওয়া প্রযুক্তিনির্ভর ও স্নায়ুযুদ্ধকালীন ভূরাজনৈতিক যুক্তির বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি ছিল বিশ্বজুড়ে উপনিবেশমুক্তির গণ–আকাঙ্ক্ষা; যেখানে জাতীয় সার্বভৌমত্বের দাবি, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক পুনর্বণ্টন—উভয় দিক থেকেই উত্থাপিত হচ্ছিল। ...

২.

১৯৭১ সালে বব এডওয়ার্ডস ও তাঁর সহকর্মীদের বিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে যাওয়া মানে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ভাষায়, ‘একটি বিপদের মুহূর্তে ঐতিহাসিক বিষয়ের সামনে ভেসে ওঠা অতীতের এক প্রতিচ্ছবি’কে গুরুত্ব দেওয়া। বাংলাদেশে একাত্তরকে দলীয় রাজনীতি ও শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে সংকীর্ণভাবে ব্যবহার করার ফলে এই বিপ্লবী মুহূর্তকে তার প্রকৃতরূপে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে; যদিও এটি ছিল শ্রেণি-সীমা অতিক্রমকারী এক আন্দোলন, যা জাতিগত-ভাষাগত স্বীকৃতি বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বাইরে গিয়ে উপনিবেশমুক্তি, পুনর্বণ্টনমূলক ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতার সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

আজ এই মৌলিক ঐতিহ্য ও তার উত্তরাধিকারীরা হুমকির মুখে। কারণ ‘১৯৭১’-এর গুরুত্ব খাটো করা একই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করছে, যেটি জুলাই ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের আগে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র সংকীর্ণ ব্যবহারে করা হয়েছিল। এই ইতিহাসে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন—এটা কি অসম্পূর্ণ রেখে গেছে তা বোঝার জন্য।

বেঞ্জামিনের ভাষায়, অতীতের এমন একটি প্রতিচ্ছবি ভিন্ন ভবিষ্যতের আশা বহন করতে পারে, যদি তা এই বিশ্বাসে উদ্ধার করা যায় যে ‘শত্রু বিজয়ী হলে মৃতরাও নিরাপদ থাকে না…এবং এই শত্রু কখনো বিজয়ী হওয়া বন্ধ করেনি।’ এখানে শত্রু হলো ১৯৭১-কে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ ও তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা, যা জাতিগত ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র ‘ঐতিহ্য’টিকেই হুমকির মুখে ফেলে।

১৯৭১ সালে এসব ফলাফল তখনো অনিবার্য ছিল না, যখন কৃষক-চাষিরা উদ্ভাবন ও ‘অদম্য দৃঢ়তা’ দিয়ে নতুন বীজ বপন ও বিতরণ করছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত তাঁদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসনকেই আরও ক্ষয় করত। তবু এই ভুলে যাওয়া সম্ভাবনার ক্ষণিক ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে—কৃষিভিত্তিক ভবিষ্যৎ অন্য রকমও হতে পারত। এটি ১৯৭১ সালের র‍্যাডিক্যাল গণতান্ত্রিক কল্পনারই আরেকটি দিক, যে কল্পনাকে আজকের আন্দোলনগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে।

১৯৭১ সালের শুরুর মাসগুলোতে রবার্ট এডওয়ার্ডস নিজেকে এক অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করেন। ২ মার্চ রাতে তিনি ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় পৌঁছান। এর ঠিক আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছিলেন। ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ শুরু হয়। প্রদেশটিতে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ৪১ জন স্থায়ী ও খণ্ডকালীন স্থানীয় ও বিদেশি (প্রধানত মার্কিন) কর্মী ছিলেন এবং তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এসে পড়ে এডওয়ার্ডসের ওপর। পরবর্তী কয়েক দিনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকায় তাদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতিও শুরু হয়।

ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে এডওয়ার্ডস ছিলেন নিউইয়র্কের সদর দপ্তরের সঙ্গে সংস্থাটির প্রধান যোগাযোগসূত্র। মাঠপর্যায়ের কর্মী ও সরকারি মহলের যোগাযোগ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সদর দপ্তরকে অবহিত করা এবং সংস্থার করণীয় নির্ধারণে সহায়তা করাই ছিল তাঁর কাজ।

ব্যক্তিগত গবেষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি ফোর্ড ফাউন্ডেশন পূর্ব পাকিস্তানে একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করত—এর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, ধান গবেষণা এবং গ্রামীণ উন্নয়ন উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য; বিশেষ করে কুমিল্লার গ্রামীণ উন্নয়ন একাডেমির মাধ্যমে। প্রায় দুই দশক ধরে পাকিস্তানে উপস্থিত থাকার ফলে সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক ছিল বিস্তৃত। এসব প্রকল্পের অনেক মার্কিন ‘পরামর্শক’ ছিলেন পেশাদার বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসক, যারা উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে নিজেদের যুক্ত মনে করতেন এবং সেগুলো গঠনে ভূমিকা রাখতেন।

স্নায়ুযুদ্ধের যুক্তিতে বৈশ্বিক দক্ষিণকে যখন প্রায়ই বর্ণবাদী প্রান্তভূমি বা প্রক্সি যুদ্ধের মঞ্চ হিসেবে দেখা হতো, তখন ‘উন্নয়ন’ পেশাজীবীদের কাজ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এক বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করেছিল, বিশেষত কৃষিনির্ভর সমাজগুলোতে। ফলে মার্চের শুরুতে সংঘটিত ঘটনাবলির পর এডওয়ার্ডস ও তাঁর ফোর্ড সহকর্মীরা দলীয় রাজনীতি, গণতন্ত্র, যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন—বিভিন্ন বিষয়ে যে বদলে যাওয়া মতামত প্রকাশ করেন, তা আসলে ‘উন্নয়ন সমস্যা’কে নতুন করে ভাবার এক বৃহত্তর প্রয়োজনেরই প্রতিফলন ছিল; যে সমস্যাটি তখন ক্রমেই আধুনিকীকরণ তত্ত্ব এবং সরবরাহপক্ষীয় অর্থনীতির আলোকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল।

৩.

মার্চের শুরুতে ঢাকায় সফরের পর এডওয়ার্ডস মন্তব্য করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের অস্থিরতা ছিল ‘বিশ্বের শেষ বুর্জোয়া স্বাধীনতা আন্দোলনের’ প্রাথমিক সাড়া। যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মূলত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উঠে এসেছিল—যাদের বিশৃঙ্খলা থেকে হারানোর ছিল অনেক, এডওয়ার্ডস মনে করেননি যে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি আছে। দলের কোনো গেরিলা শাখা ছিল না, আর সামরিক রসদ মজুতের খবরও পাওয়া যায়নি, কেবল মাঝেমধ্যে সেনা সরবরাহ বহরে বিঘ্ন ঘটানোর ঘটনা ছাড়া। ‘এখনো আমার কাছে এটি সংগঠনের চেয়ে বেশি একধরনের গণ–উচ্ছ্বাস বলেই মনে হয়’ —এডওয়ার্ডস মন্তব্য করেছিলেন।

কিন্তু এপ্রিল নাগাদ পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নেয়। ১০ এপ্রিল ইউজিন স্ট্যাপলসকে লেখা এক চিঠিতে এডওয়ার্ডস ২৬ মার্চের পর থেকে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন; যা ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড তাঁর যে বার্তায় স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানিয়েছিলেন, পরে যা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে কুখ্যাতভাবে ফাঁস হয়, তার সঙ্গে এর সুর মিলেছিল।

এডওয়ার্ডস পূর্ব পাকিস্তানে গণপ্রতিরোধ বাড়ছে—এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ কর্মকর্তার অস্বীকারের প্রবণতা প্রত্যাখ্যান করেন। গ্রামাঞ্চল থেকে আসা প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছিল, ‘গ্রামীণ মানুষেরা রাস্তাঘাট কেটে দেওয়া এবং ফেরিঘাট পুড়িয়ে দিতে যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ এই দাবির প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায়, দমন অভিযানের দুই সপ্তাহের মধ্যেই দখলদার বাহিনীকে তাজা সবজিসহ নানা রসদ আকাশপথে আনতে হচ্ছে। এডওয়ার্ডস লক্ষ্য করেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় উপস্থিতি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি টেকসই এবং তিনি অনুমান করেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা তৎপরতা সম্ভবত আওয়ামী লীগারদের চেয়েও কঠিন প্রতিপক্ষ সামনে আনবে।’

আরও পড়ুন

১৬ থেকে ২১ মে পূর্ব পাকিস্তানে এক ‘তথ্য অনুসন্ধান’ সফরের পর এডওয়ার্ডস আওয়ামী লীগের শ্রেণি-অতিক্রমী আকর্ষণের চরিত্র নতুন করে মূল্যায়ন করেন। তাঁর মতে, ‘অর্থনীতি, সেনাবাহিনী ও নাগরিক সমাজ’ থেকে বঞ্চিত হওয়াকে মানুষ জাতিগত ভিত্তিতে অর্থনৈতিক শোষণের অনুভূতির সঙ্গে এক করে দেখছিল। ঢাকায় দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সীমিত হলেও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক এডওয়ার্ডস বুঝতে পারেন, ‘এমনকি চালক, বাহক ও অফিসের সেক্রেটারিরাও এই অর্থনৈতিক শোষণের অনুভূতি প্রকাশ করছে।’

বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য এই অনুভূতির তাৎপর্য এডওয়ার্ডসের অজানা ছিল না। ২৭ মে লেখা এক চিঠিতে তিনি লেখেন: ‘১২৭৯ সাল (প্রথমবারের মতো পূর্ব বাংলাকে আলাদা একটি ‘রাজ্য’ হিসেবে ঘোষণার বছর) থেকে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন পর্যন্ত বহুবার বাংলাবিদ্রোহ পুনরাবৃত্ত হয়েছে… প্রায় সব ক্ষেত্রেই এটি পশ্চিমের অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ—মুসলমানদের নেতৃত্বে, তবে হিন্দুদের সমর্থনসহ এবং ‘‘বাঙালিত্বের’’ অনুভূতিতে সিক্ত।’

এটি এক মাস আগের এডওয়ার্ডসের ‘জনগণের ইচ্ছা’ বিষয়ে অনুমান থেকে স্পষ্টভাবে ভিন্ন ছিল। তখন তিনি ‘শৃঙ্খলা’র প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে অস্থিরতার জন্য দায়ী করেছিলেন বিশাল ছাত্র-যুব জনগোষ্ঠীকে। তাঁর ভাষায়, তাঁরা ‘যাদের স্বার্থে শৃঙ্খলা প্রয়োজন এমন গৃহস্থদের মতো নয়’; বরং ‘একঘেয়েমি, আধা কর্মসংস্থান ও তোষামোদে ভরা জীবনের’ বিকল্প হিসেবে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকা যেকোনো রাজনৈতিক বিশ্বাসের’ দিকে আকৃষ্ট। যদিও সেই দৃষ্টিভঙ্গি উদীয়মান মধ্যবিত্ত যুবকদের অসন্তোষের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণগুলো চিহ্নিত করেছিল; তবু খুব দ্রুত সেই জনসংখ্যাভিত্তিক ব্যাখ্যার জায়গা নেয় বৈশ্বিক উপনিবেশমুক্তির যুগচেতনায় প্রভাবিত এক যুগান্তকারী ব্যাখ্যা।

আরও পড়ুন

পরবর্তী মাসগুলোতে এডওয়ার্ডস ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অন্যান্য কর্মকর্তারা পাকিস্তানের বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্রের গণতন্ত্রবিরোধী অবস্থান থেকে নিজেদের দূরে সরাতে বাধ্য হন—যে আমলাতন্ত্র কয়েক দশক ধরে ‘মুসলিম জাতির টিকে থাকা’ নিশ্চিত করার নামে গণতন্ত্রীকরণ আটকে রেখেছিল। নভেম্বর নাগাদ, যিনি একসময় আইয়ুব খানের পতনে আক্ষেপ করেছিলেন, সেই স্ট্যাপলসও স্বীকার করেন—বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া দাবিগুলো হয়তো কেবল ব্যর্থ গণতন্ত্রীকরণের ফল নয়; বরং ভবিষ্যতে গণতন্ত্র অর্জনের পূর্বশর্ত, অন্তত পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে।

ব্যক্তিগত আলাপের বিবরণ দিতে গিয়ে এডওয়ার্ডস সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের কথা বলেন, যিনি পরে ‘বাংলার কসাই’ নামে কুখ্যাত হন। এডওয়ার্ডস তাঁকে বর্ণনা করেন ‘একজন মানুষ হিসেবে, যিনি দুঃখজনকভাবে নিজের সামর্থ্যের বাইরে… এমন এক পরিস্থিতিতে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, যা তিনি খুব অস্পষ্টভাবে বোঝেন।’

আলাপের সময় টিক্কা খান যখন তাঁর নৃশংস অভিযানের ‘খরচ’ যুক্তিসংগত করতে গিয়ে বলেন, ‘আমেরিকার গৃহযুদ্ধেও তো বহু গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল’, তখন এডওয়ার্ডস তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি উল্লেখ করেন, সেই সংঘাতের তিক্ততা এক শতাব্দী ধরে টিকে ছিল; পাশাপাশি আলজেরিয়ার ঔপনিবেশিক যুদ্ধে মানবিক ক্ষয়ক্ষতির উদাহরণ টেনে টিক্কার অভিযানের প্রতি পরোক্ষ সমালোচনা করেন। এডওয়ার্ডস ভিয়েতনামে আমেরিকার ভূমিকার ভণ্ডামিও তুলে ধরেন।

মার্চে সরকারি ব্যাখ্যার কাঠামো তখনো ‘আদিম’ সহিংসতার শিকড়ে আবর্তিত ছিল—বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে এবং পরে উর্দুভাষী ‘বিহারি’দের সঙ্গে। ধারণা ছিল, আধুনিকীকরণ এই ‘বাঙালির প্রাচীন সংগঠিত দুষ্কৃতির ঐতিহ্য—যেখানে প্রতিবেশী প্রতিবেশীর ওপর চড়াও হয়’—উপড়ে ফেলবে। মে মাসে এডওয়ার্ডস ও অনেকেই এই জাতিবর্ণভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করেন। তাঁরা ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র ও তার সামরিক তৎপরতাকে ‘উন্মাদ’ বলে আখ্যা দেন, হিন্দু ও সাধারণভাবে বাঙালিদের পদ্ধতিগতভাবে লক্ষ্যবস্তু করার ঘটনাকে ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং দোষ চাপান দখলদার সামরিক বাহিনীর ওপর—দখলকৃত জনগণের ওপর নয়।...

৪.

নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ যুদ্ধের কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। সংঘাত শুরুর আগেই ফোর্ড ফাউন্ডেশন ‘উন্নয়ন সমস্যাকে’ ক্রমেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য উৎপাদন—এই দুই সূচকের মধ্য দিয়ে দেখতে শুরু করেছিল।

মে মাসে এডওয়ার্ডসের সঙ্গে কথোপকথনে টিক্কা খান বলেছিলেন, পরিবার–পরিকল্পনা কর্মসূচি অবশ্যই চালু রাখতে হবে। কারণ, বাঙালিরা ‘অত্যধিক হারে বংশবিস্তার করে’। যুদ্ধের শেষে এসে এ ধরনের নগ্ন বর্ণবাদী ধারণা আর টিকতে পারেনি। ১৯৭২ সালের শুরুতে নতুন (বাংলাদেশ) রাষ্ট্রের পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক মন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের জানান, যুদ্ধজনিত ‘মানসিক প্রভাবের’ কারণে এসব কর্মসূচির বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ‘বৈরিতা’ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি আশাব্যঞ্জক সম্ভাবনা দেখা দেয় ধান গবেষণায়, যা তারা ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন কৃষিতে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে অর্থায়ন করেছিল।

লক্ষণীয় যে যুদ্ধ চলাকালেও জয়দেবপুরসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চফলনশীল ধানের জাত নিয়ে গবেষণা অব্যাহত ছিল। আরও বিস্ময়কর হলো, সংঘাত শুরুর কয়েক বছর আগে চালু হওয়া আইআর–২০ জাতটির ব্যবহার যুদ্ধের মধ্যেই কৃষক থেকে কৃষকে বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। স্ট্যাপলসের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে এই জাতের আওতায় চাষ হওয়া জমির পরিমাণ ১০ গুণ বেড়ে এক মিলিয়ন একরের বেশি হয়ে যায়।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আইআর–২০-এর এই সাফল্যকে এডওয়ার্ডস কৃষকদের ‘অদম্য দৃঢ়তা’ বলে অভিহিত করেছিলেন; এর প্রমাণ হলো তিনি ভিয়েতনাম ও বাংলার গ্রামীণ ভূদৃশ্যের মধ্যে তুলনাও টেনেছিলেন। একাত্তর ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সামনে কৃষক-চাষিদের স্বায়ত্তশাসন ও স্বার্থ নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছিল এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর সীমা ছাড়িয়ে ‘উন্নয়ন সমস্যা’কে পুনর্বণ্টনমূলক লক্ষ্য দিয়ে পুনর্বিবেচনার পথ খুলেছিল।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের ‘সবুজ বিপ্লব’-এর দ্রুত সম্প্রসারণ এই পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে দেয়। কারণ, সেখানে কৃষি উন্নয়নের অন্যান্য সূচকের চেয়ে ফলন বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া একদিকে বিস্তৃত ধান গবেষণা অবকাঠামো গড়ে তোলে এবং কিছু কৃষক, ঋণদাতা, উপকরণ আমদানিকারক ও পরিবেশকদের জন্য নতুন সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি করে; অন্যদিকে এর খরচও ছিল বড়—গ্রামীণ বৈষম্য বৃদ্ধি, কৃষিজ জমি থেকে উচ্ছেদ এবং পরিবেশগত ক্ষতি।

১৯৭১ সালে এসব ফলাফল তখনো অনিবার্য ছিল না, যখন কৃষক-চাষিরা উদ্ভাবন ও ‘অদম্য দৃঢ়তা’ দিয়ে নতুন বীজ বপন ও বিতরণ করছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত তাঁদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসনকেই আরও ক্ষয় করত। তবু এই ভুলে যাওয়া সম্ভাবনার ক্ষণিক ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে—কৃষিভিত্তিক ভবিষ্যৎ অন্য রকমও হতে পারত। এটি ১৯৭১ সালের র‍্যাডিক্যাল গণতান্ত্রিক কল্পনারই আরেকটি দিক, যে কল্পনাকে আজকের আন্দোলনগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে।

  • মুশাহিদ হুসেন ভিজিটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, সেন্টার ফর আরবান অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজ, ট্রিনিটি কলেজ, কানেটিকাট

*মতামত লেখকের নিজস্ব