রাবিতে ছাত্র-স্থানীয় সংঘর্ষ: পুলিশকে গুলি করার অনুমতি কে দিল?

‘ইদানীং লক্ষ করা যায় কোনো একটি সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য পুলিশ শর্টকাট উপায় হিসেবে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বা দমনের নীতি অবলম্বন করে থাকে। যার কারণে প্রাণহানির ঘটনা পর্যন্ত ঘটে থাকে।’
ছবি: প্রথম আলো

গত ১১ মার্চ ঘটনার শুরু বাসের কর্মচারীর সঙ্গে শিক্ষার্থীর বাগ্‌বিতণ্ডা দিয়ে। সেটি গড়ায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীর। পরে সংঘর্ষ রূপ নেয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়দের। শেষে এসে সেটি দাঁড়াল পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রাও বাড়তে থাকে। শুরুতে চড়-থাপ্পড়, পরে ইট ছোড়াছুড়ি, টিয়ার শেল, সবশেষে আগুন এবং শটগানের ছররা গুলি। এর পরিণতি দাঁড়ায় ভয়াবহ। ইটের আঘাতে আর টিয়ার শেলে শত শত শিক্ষার্থী আহত হলো, পেলেটবিদ্ধ হলো অনেক শিক্ষার্থী।

‘ডোন্ট ফায়ার, আই সে, ডোন্ট ফায়ার’—ছাত্রদের বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে এভাবে চিৎকার করেছিলেন ড. শামসুজ্জোহা। শহীদ শামসুজ্জোহার সেই ক্যাম্পাসে পুলিশ গুলি চালাল কিন্তু সেখানে গুলি না চালানোর জন্য অনুরোধ করার মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তারা পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়নি। পুলিশ অবৈধভাবে গুলি চালিয়েছে। পুলিশের পক্ষে বলা হচ্ছে, তাদের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে গুলি চালিয়েছে।

এভাবেই একটি তুচ্ছ ঘটনার অনেক ভয়াবহ পরিণতি হলো। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন মেহেরচণ্ডী, বিনোদপুরের সঙ্গে এরূপ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এত শিক্ষার্থী আহত কিংবা গুলিবিদ্ধ হননি। স্থানীয়দের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ একটি সাধারণ বা তুচ্ছ ঘটনা নয়। বরং এটিকে তুচ্ছ বলে তাচ্ছিল্য করলেই এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। যেকোনো কারণেই হোক ছাত্র-স্থানীয় সংঘাত হতে পারে কিন্তু এটি এতটা ভয়াবহ আকার নেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একটি সংঘর্ষ চূড়ান্ত আকার ধারণ করতে সময় নেয়, এর মধ্যে সেটি প্রশমনের সুযোগ থাকে। যা নিরসন করা যেতে পারে বিভিন্ন উপায়ে। তবে এবার আমরা দেখলাম এ ঘটনার চূড়ান্ত রূপ নিল শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির মধ্য দিয়ে। শেষমেশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, তা একটি অনিয়ন্ত্রিত ঘটনার ফল। এটিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনাকে স্থানীয় এবং নিজস্ব সমস্যা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। এ সমস্যাগুলো শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত নয়। দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ভবিষ্যতে দেশের কোনো শিক্ষাঙ্গনে এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে কারণগুলো অনুসন্ধানের জন্য। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে, তা হলো পুলিশ কেন শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালাল? এই গুলি চালানোর অনুমতি তাঁরা কোথায় পেল?

পুলিশের ছররা গুলিতে আহত একজন শিক্ষার্থী

শুধু ছাত্র নয়, যেকোনো নাগরিকের ওপর পুলিশের গুলি চালানো, একটি গুরুতর বিষয়। একটি পরিস্থিতির সমাধান বা সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশ অনেক সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে পুলিশ ডাকা কতটা সমীচীন? ইদানীং লক্ষ করা যায় কোনো একটি সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য পুলিশ শর্টকাট উপায় হিসেবে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বা দমনের নীতি অবলম্বন করে থাকে। যার কারণে প্রাণহানির ঘটনা পর্যন্ত ঘটে থাকে। আপাতদৃষ্টে যখন একটি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব ছিল, সেখানে পুলিশ গুলি চালায়।

এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালাতে হলে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশক্রমে হতে হবে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনায় তার ব্যত্যয় ঘটেছে। যে সমস্যাটি সমাধানযোগ্য সেটিকে বলপ্রয়োগ করে পরিহারের এই পন্থা কাম্য নয়। যেখানে সিটি মেয়র এবং উপাচার্য নিজে উপস্থিত ছিলেন সেখানে কেন সমস্যার সমাধান হলো না, সেটি দুঃখজনক। সেদিন রাত ১০টার পর যখন মেয়র এবং উপাচার্য ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তারপরেই পুলিশ উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায়। সেখানে শত শত উত্তেজিত শিক্ষার্থীকে অনিরাপদ রেখে ঘটনাস্থল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চলে আসা সমীচীন হয়নি। যার পরিণতি শিক্ষার্থীরা পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হলেন। পরদিন একটি জাতীয় পত্রিকায় সিটি মেয়রের বক্তব্য এল—যতক্ষণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বে ছিল ততক্ষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল, যখনই ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদল উসকানি দিল, তখন পরিস্থিতি খারাপ হলো। তাহলে কি পুলিশ প্রশাসনও ভেবেছিল এখন যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল; ফলে গুলি চালিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যেতেই পারে?

আরও পড়ুন

এ ঘটনায় প্রশাসন দায় এড়াতে পারেন না। ক্যাম্পাসে ছাত্রদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রশাসনের। সাধারণত পুলিশের গুলি চালানো একটি সর্বশেষ উপায় হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ এত দ্রুত ধৈর্য হারাল কেন, সেটি অস্পষ্ট। এখানে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার, তা হচ্ছে, এক. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে একটি সমন্বয়হীনতা, দুই. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনজাগতিক বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হয়নি, এবং তিন. বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি, বিশেষ করে ক্যাম্পাসে চলা দীর্ঘ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নীরবতা এবং বিচারহীনতার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি।

আরও পড়ুন

পুলিশের গুলি ব্যবহারের আইনি বিধানগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে কি না, আমরা নিশ্চিত নয়। তবে এই শিক্ষাঙ্গনের একজন অভিভাবক হিসেবে আমার এটি জানার অধিকার আছে কেন শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালান হলো? যখন পুলিশের গুলিতে আমার শিক্ষার্থীর পুরো শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেছে, পুলিশের গুলিতে যখন আমার ছাত্রটি হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছ, মস্তিষ্কে গুলির পেলেট নিয়ে, পেলেটবিদ্ধ পরিপাকনালি নিয়ে যখন আমার ছাত্র অপারেশন থিয়েটারে যাচ্ছে, তখন এটি জানা আমার অধিকার। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর কার নির্দেশে গুলি চালাল? তার জবাব চাই।

  • ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
    ই-মেইল: [email protected]