মেটাভার্স কি হতে চলেছে ভবিষ্যতের অন্ধকার জগৎ

এ বছরের শুরুর দিকে অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটে গেল যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ পুলিশ প্রথমবারের মতো ভার্চ্যুয়াল জগতে ধর্ষণের শিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক এক কিশোরীর করা অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট পরে মেটাভার্সে মগ্ন ছিল গেম খেলায়। সেই মেটাভার্স বা ভার্চ্যুয়াল জগতে কয়েকজন মিলে মেয়েটির অ্যাভাটার বা অবতার আক্রমণ করে দলগতভাবে ধর্ষণ করে। (দ্য গার্ডিয়ান, ৫ জানুয়ারি ২০২৪)

মনে হতে পারে, যে জিনিসের বাস্তবে অস্তিত্বই নেই, সে জিনিসের এত গুরুত্ব কেন। ব্যাপারটি সম্ভবত বাস্তব-অবাস্তবের নয়, ব্যাপারটি হলো অনুভূতির। আমরা যে স্বপ্ন দেখি, সেটি কিন্তু বাস্তবে ঘটে না, তবু সেটির প্রভাব থাকে; স্বপ্ন দেখে মানুষ আনন্দিত হয়, ব্যথিত হয়। একইভাবে আলোচিত ভার্চ্যুয়াল জগৎ বা মেটাভার্স প্রভাব রাখতে পারে অনুভূতিতে, কারণ হতে পারে আনন্দ-বেদনার।

১৯৯২ সালে নিল স্টিভেনসনের স্নো ক্র্যাশ নামক কল্পবিজ্ঞান বইয়ের মাধ্যমে প্রথম আসে ‘মেটাভার্স’ শব্দটি। জনপ্রিয়তা লাভ করে ২০২১ সালে ‘ফেসবুক’ নাম পরিবর্তন করে ‘মেটা’ রাখার পর। ‘মেটা’ ও ‘ইউনিভার্স’ শব্দের সমন্বয়ে তৈরি মেটাভার্সের শাব্দিক অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘মহাবিশ্বের বাইরে’।

কোন দেশের আইন প্রয়োগ হবে সেখানে ঘটে যাওয়া অপরাধের? হঠাৎ করে বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল জগতের পার্থক্য করতে না পারায় সৃষ্ট সমস্যারই–বা কী হবে সমাধান। বাস্তবের পৃথিবীর অন্ধকার জগতের যে অপরাধ, কী করে ভার্চ্যুয়াল জগতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তা।

প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ইন্টারনেটের পরবর্তী রূপ হলো মেটাভার্স। মূলত আমাদের বাস্তব পৃথিবীর মতো ত্রিমাত্রিক আবহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটিতে ব্যবহৃত হয় ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট, অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) লেন্স; সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহৃত হয় ব্লকচেইন, আইওটি, এআই, এনএফটির মতো প্রযুক্তি। কৃত্রিম উপায়ে অনুভূতি সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয় হ্যাপটিকস, গ্লাভস, ভেস্ট, বডি ট্র্যাকিং স্যুটসহ নানাবিধ প্রযুক্তি।

বর্তমানে অনলাইন গেমের কারণে এটি ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। বলা হয়ে থাকে যে ডিজিটাল (ভার্চ্যুয়াল) আর ফিজিক্যাল (বাস্তব) পৃথিবীর সেতুবন্ধ করে দিচ্ছে এই প্রযুক্তিগুলো। এমন একটি গেমের উদাহরণ দেওয়া যাক, যে ধরনের কাজ এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে। ভার্চ্যুয়াল হেডসেট পরার পর দেখা গেল, একটি ক্রিকেট মাঠের পিচে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। এক প্রান্ত থেকে বল করার জন্য এগিয়ে আসছে ভার্চ্যুয়াল বোলার, এ প্রান্তে আপনার হাতে আছে ব্যাট। বোলার বল করতেই আপনি ব্যাট চালালেন, শুনতে পেলেন দারুণ টাইমিং হওয়ার শব্দ। বল উড়ে গিয়ে পড়ল গ্যালারিতে। দর্শকেরা তুমুল করতালির মাধ্যমে আপনাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।

ভার্চ্যুয়াল জগৎ আর বাস্তব জগৎ মিলিয়ে কীভাবে গেমটি তৈরি করা হলো, সেটি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। বোলার ও তার বল কৃত্রিম বা ভার্চ্যুয়াল; ব্যাটসম্যান অর্থাৎ, আপনি ও আপনার ব্যাট বাস্তব বা ফিজিক্যাল। এগুলোর সঙ্গে আরও যুক্ত করা যাবে ব্যাট দিয়ে বল মারার সময় আপনার হাতে ঝাঁকুনি দেওয়া, বল কানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাতাসের শব্দ দেওয়া, ইত্যাদি। এসব আয়োজন সৃষ্টি করে ‘উপস্থিতির অনুভূতি’, যেটি আসলে মেটাভার্সের গুরুত্বপূর্ণ এক বৈশিষ্ট্য।

মেটাভার্সে সাধারণত ব্যবহারকারীর ভার্চ্যুয়াল প্রতিকৃতি বা অ্যাভাটার থাকে। বিভিন্ন ব্যবহারকারী নিজেদের অ্যাভাটারের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, বিভিন্ন কার্যকলাপ করবে।

বাস্তবের পৃথিবীতে বাংলাদেশ থেকে চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে কেউ আমেরিকায় বসে থাকা বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল জগতে একজনের অ্যাভাটার বাংলাদেশ থেকে মুহূর্তেই চলে যেতে পারবে আরেকজনের অ্যাভাটারের কাছে। বাস্তবের মানুষ যা করবেন, অ্যাভাটারও সেটি নকল করবে। প্রশ্ন হলো, অ্যাভাটারদের সাক্ষাৎ হওয়ার পর ভিআর হেডসেট পরে থাকা বাস্তবের মানুষদের অনুভূতিতে সে সাক্ষাৎ কতটুকু নাড়া দিতে পারবে।

আরও পড়ুন

ইন্টারনেট যেমন অনেকগুলো নেটওয়ার্কের সংযোগে তৈরি একক একটি ব্যবস্থা, একইভাবে ভার্চ্যুয়াল জগৎগুলোর সমন্বয়ে একক মেটাভার্স ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। এর অনেকাংশই এখনো শুধু তাত্ত্বিকভাবেই আলোচিত হলেও পৃথিবী কিন্তু সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন মেটাভার্স ব্যবহারকারী।

যুক্তরাজ্যে হওয়া এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবদ্দশায় প্রায় ১০ বছর কাটাবে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির মেটাভার্সে, দৈনিক হিসাবে যেটি প্রায় ৩ ঘণ্টা। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সীদের শতকরা ২১ ভাগের কাছে ইতিমধ্যে ভিআর হেডসেট আছে এবং জন্মদিন বা বড়দিনের জন্য তারা সে ধরনের উপহারই চাইতে শুরু করেছে (আইইটি, ২০২২)।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে ভার্চ্যুয়াল জগৎ আবেগ-অনুভূতিতে প্রভাব রাখতে পারে, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কারণ হতে পারে, কী হবে সেই জগতের নিয়মকানুন! বাস্তবের পৃথিবীতে একই অপরাধের শাস্তি একেক দেশে একেক রকম। একই কথা এক দেশের গালি, অন্য দেশের বুলি; একই পোশাক এক দেশে সংস্কৃতি, তো অন্য দেশে দুষ্কৃতি।

কোন দেশের আইন প্রয়োগ হবে সেখানে ঘটে যাওয়া অপরাধের? হঠাৎ করে বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল জগতের পার্থক্য করতে না পারায় সৃষ্ট সমস্যারই–বা কী হবে সমাধান। বাস্তবের পৃথিবীর অন্ধকার জগতের যে অপরাধ, কী করে ভার্চ্যুয়াল জগতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তা।

● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

[email protected]