গত বছরের ডিসেম্বর ছিল বেশ ‘গরম’ মাস। পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি, ‘গায়েবি’ মামলা, ধরপাকড়, এমনকি প্রাণহানি—সব মিলিয়ে এতটা তাপ-উত্তাপ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কোনো একক মাসে ছড়ায়নি। এরপর নতুন বছরের প্রথম মাসেই গত কয়েক বছরের মধ্যে এত ‘ঠান্ডা’ পড়ল। দ্বিতীয় এই দশার সঙ্গে রাজনীতির যোগ নেই, কিন্তু বিস্তৃত অর্থে প্রকৃতির এই ‘অচেনা আচরণের’ জন্য দায়ী কমবেশি আমরা সবাই।
সুতরাং ‘গরম’ বা ‘ঠান্ডা’ যা-ই ছড়াক, তার পেছনে থাকে কার্যকারণ, হোক তা রাজনীতির ময়দানে কিংবা প্রকৃতির অঙ্গনে। সুতরাং জরুরি প্রশ্নটা হলো, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কতটা আমলে নিচ্ছে এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থাই–বা নিচ্ছে কতটা?
স্কুল-কলেজের কচি-কাঁচাদের আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে—এমন আশাবাদ তৈরি হয়েছিল সরকারের দেওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতেই। কিন্তু আইন পাসের পর নানা টালবাহানায় চার বছর পরে যে বিধিমালা হলো, তাতে কি চালকদের ‘দৌরাত্ম্যে’ এতটুকু ভাটা পড়বে?
ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকা সড়কে মৃত্যুর মিছিলের ক্ষেত্রে এ কথা বলা বোধ করি ভুল হয় না যে এক পক্ষ যদি ঠুলি-মাফলারের আশ্রয় নিয়ে থাকে, অপর পক্ষও চোখে যে কিছু দেখছে বা কানে শুনছে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। রাজনৈতিক উত্তাপ কিংবা শীতের দাপট নিয়ে যত কথাবার্তা উচ্চারিত, সড়কে মৃত্যুর নতুন নতুন ‘রেকর্ড’ নিয়ে ততটাই যেন ‘নীরবতা’ চারদিকে।
সড়কে প্রাণহানি আগে থেকেই পরিসংখ্যান হয়ে ছিল, এখন সেই পরিসংখ্যান যেন স্রেফ মহাফেজখানার তাক ভরানোর কাজে লাগছে। বাকি থাকে শুধু স্বজন-সন্তান হারানো মানুষের হাহাকার-আহাজারি, ন্যায়বিচারের জন্য মাথা ঠোকা। এটুকু ‘উপেক্ষা’ করতে পারলেই সব ঠিকঠাক। কর্তৃপক্ষ তেমন ঠিকঠাকের পথেই আছে!
‘এখন আর আকাশ থেকে বাংলাদেশে কুঁড়েঘর দেখা যায় না’—৮ জানুয়ারি সরকারের এক মন্ত্রী বললেন এই কথা। তাঁর কথা হয়তো সত্যই। তবে একটু ভালো করে খেয়াল করলে সড়কে রক্তের দাগ তো চোখ এড়ানোর কথা নয়। ২০২২ সালে সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৫৪৮ জন, যা ২০১৯ সালের পর সর্বোচ্চ। এত মানুষের রক্তে ভিজেছে ‘উন্নয়নের’ সড়ক-মহাসড়ক। হাজারো যানের চলাচলে ঘটনার দু-চার ঘণ্টা পর রক্তের লেশটুকুও থাকার কথা নয় বটে, কিন্তু স্বজন হারানো মানুষগুলোর বুকের ভেতরের রক্তক্ষরণ কি কখনো বন্ধ হবে—যখন জানি, সড়কে মৃত্যু আর ‘দুর্ঘটনা’ নয়।
যতভাবে নিয়ম ভঙ্গ করা যায় এবং যত অনিয়মের আমদানি করা যায়, তার ‘শ্রেষ্ঠ জায়গা’ বুঝি সড়ক। বেপরোয়া গাড়িচালনা, বিপজ্জনক পাল্লাপাল্লি, উল্টো পথে অবাধ চলাচল, লেন-বিভাজনের তোয়াক্কা না করা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, দ্রুতগতির যানের পাশে কম গতির যানের চলাচল, লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির সমাহার, মোটরসাইকেলের দাপট, ফুটপাত ছাপিয়ে সড়কের ওপর বাজার, যেখানে-সেখানে পার্কিং, সড়কের ত্রুটি, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা—সব মিলিয়ে নৈরাজ্যের নিখুঁত উদাহরণ দেশের পরিবহন খাত, সড়কব্যবস্থা। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই।
এত এত অকাল ও অপঘাতের মৃত্যুর খবরেও যখন আমাদের বুকে কাঁপন ধরে না, তখন বুঝতে হবে আমাদের মনোজগতের ‘ষড়্ঋতু’ও বদলে যাচ্ছে। যখন প্রতিবাদে মুখর হওয়ার কথা, তখন ফেসবুকে ‘স্ট্যাটাস’ দিয়ে দায় সারছি! ন্যায়ের জন্য আকাঙ্ক্ষা না থাকলে অন্যায়কে ঝেঁটিয়ে বিদায়ের তাগিদ আসবে কেন? সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর যে বিধিমালা হলো, তাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ (পড়ুন: মানুষের ‘প্রাণের দাম’) ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। আপনি হাত-পা খুইয়ে ন্যাংড়া-নুলা হয়ে যদি বেঁচে থাকেন, অর্থাৎ স্বাভাবিক জীবনে না ফেরেন, তাহলে পাবেন তিন লাখ টাকা।
স্কুল-কলেজের কচি-কাঁচাদের আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে—এমন আশাবাদ তৈরি হয়েছিল সরকারের দেওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতেই। কিন্তু আইন পাসের পর নানা টালবাহানায় চার বছর পরে যে বিধিমালা হলো, তাতে কি চালকদের ‘দৌরাত্ম্যে’ এতটুকু ভাটা পড়বে? অনেক উদাহরণের একটিই সামনে আনা যাক, গত বছরের ১৫ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে টগবগে তরুণ আবু সায়েমকে যে কায়দায় বাস থেকে ফেলে ‘হত্যা’ করা হয়েছে, তাতে বিধিমালা অনুযায়ী ওই বাসচালকের ১২টি ‘দোষসূচক পয়েন্টের’ কয়টি কাটা পড়বে?
সড়ক পরিবহনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের কারণে একটি বা দুটি পয়েন্ট কেটে নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে বিধিমালায়। সব পয়েন্ট হারানো চালকের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আচ্ছা, এখন কয়জন চালকের ঠিকঠাক লাইসেন্স আছে?
ক্ষমতার চৌম্বকক্ষেত্রে রাজনীতি আটকা পড়ে গেছে, রাজনীতিবিদেরা কেবল সেখানেই আকৃষ্ট হন! আইনপ্রণেতার কাতারে সংখ্যায় বাড়ছে পরিবহনসহ সব খাতের ব্যবসায়ীরা। সুতরাং নীতিনির্ধারণে তার ছাপ পড়বেই।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক।