ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে অগোচরে

ফসলি জমিতে কাজ করতে করতে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলা দয়াল চন্দ্র বর্মণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়
ছবি : সংগৃহীত

ভেতরে-ভেতরে বিপ্লব ঘটে গেছে। এটি শুনে আঁতকে উঠলেন? ভীতসন্ত্রস্ত মনে প্রশ্ন জাগছে, কিসের বিপ্লব? কোথায় বিপ্লব? ভয় নেই, রাজনৈতিক কোনো বিপ্লব ঘটেনি। ক্ষমতার পালাবদলও হয়নি। নেই মারামারি বা রক্তক্ষয়ও। এটি প্রযুক্তিনির্ভর ভিন্নধারার বিপ্লব। কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম জগতে তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ ভেতরে-ভেতরে এই বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।

কনটেন্ট প্রজন্মের এই তরুণ-তরুণীরা সরকারি কিংবা বেসরকারি চাকরির ধার ধারেন না। কোনো চাকরির প্রস্তাবেও তাঁরা পাত্তা দেন না। অন্যের অধীনে কাজ করতে চান না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কাজে লাগিয়ে নিজেই নিজের মতো তৈরি করেছেন জীবিকার পথ। আবার তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি কনটেন্ট তৈরি করে বিকল্প আয়ের পথ করেছেন। দেশে এমন আয়ের পথ প্রথম দেখিয়েছেন যারা তাদের একজন ইউটিউবার সালমান মুক্তাদির। ইউটিউবে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনুষ্ঠিত ইউটিউব উৎসবে প্রথম বাংলাদেশি সফল ইউটিউবার হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।  

অবশ্য এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে ‘ভিউ পাগলা’ কিছু ইউটিউবার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর সস্তা, নিম্নমান ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও পোস্ট করে অর্থ আয় করেন। আবার কেউ কেউ গুজব ছড়িয়ে সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট করেন অথবা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেন, যা অপরাধ, নীতিনৈতিকতাবিরোধী ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের নিজেদের প্রচেষ্টায় মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত।

ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের নজির স্থাপন করেছে তরুণ প্রজন্মের এ অংশ। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে রেভিনিউ হিসেবে ডলার আয় করছেন তাঁরা, যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এঁদের মধ্যে যেমন অত্যন্ত মেধাবী ও বিচক্ষণ তরুণ-তরুণী আছেন, তেমনই মেধাহীনরাও আছেন। কেউ লাইফস্টাইল ভ্লগ, কেউ ফুড ভ্লগ, কেউ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বিনোদন বিষয়ে কনটেন্ট পোস্ট করে অর্থ উপার্জন করছেন। কোনো কোনো কনটেন্ট ক্রিয়েটরের মাসিক আয় দেশের প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবীদের বেতনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। গত কয়েক বছরে ভেতরে-ভেতরে এমন প্রজন্মটি তৈরি হয়েছে দেশে।

এর মাধ্যমে অনেকে আত্মকর্মসংস্থান করে নিয়েছেন। তাঁরাও একধরনের ফ্রিল্যান্সার। তাঁরা কোনো বিষয়ে জনমত তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নেটিজেন সম্প্রদায় তাঁদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। এ জন্য তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাঁদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন, যা উপেক্ষিত।

শামস আফরোজ চৌধুরী, যিনি ‘থটস অব শামস’ নামে পরিচিত। এই তরুণী শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে সফল হয়েছেন। তাঁর নিজের অভিনীত ও সম্পাদিত ভিডিও দেখেন লাখ লাখ মানুষ। এর মাধ্যমে তিনি ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে বেশ ভালো অঙ্কের অর্থ উপার্জন করছেন। ফেসবুকে তাঁর ফলোয়ার ২৭ লক্ষাধিক আর ইউটিউবে সাবস্ক্রাইবার ৬ লাখের বেশি। ২০২১ সালের জুলাইয়ে আরটিভি নিউজে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে শামস আফরোজ বলেন, ‘কনটেন্ট ক্রিয়েট করে যাঁরা পরিচিতি লাভ করেছেন, তাঁদের মাসিক আয় অনেক টাকা। কেউ আছে মাসে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করে থাকেন। কারণ, এখানে মনিটাইজেশনের মাধ্যমে অ্যাডসেন্স থেকে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া স্পনসর থেকে বিশাল একটা অর্থ আয় হয়। তবে আমি সব মিলিয়ে মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় করে থাকি।’

বর্তমানে শামসের ভক্তকুল আরও বেড়েছে, সে ক্ষেত্রে তাঁর আয়ও বেড়ে যাওয়ার কথা। শামসের মতো অনেকেই এখন ভিডিও কনটেন্ট তৈরির স্বাধীন পেশা বেছে নিয়েছেন। অবশ্য আমজনতা এ পেশাকে এখনো স্বীকৃতি দিতে চায় না। বিয়ের বাজারে এ পেশার পাত্র বা পাত্রীর চাহিদা কম। তবে অর্থ উপার্জন, নাম, যশ, খ্যাতি ও জমকালো জীবনযাপনের দিক থেকে তাঁরা বিসিএস ক্যাডার, ব্যাংকার বা প্রতিষ্ঠিত সরকারি চাকরিজীবীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

আয়মান সাদিক, তৌহিদ আফ্রিদি, তাসরিফ খান, স্বপন আহমেদ, রাফসান দ্য ছোট ভাই, আএনএআর, আবদুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, সালাহউদ্দীন সুমন, দয়াল চন্দ্র, ভিলেজ লাইফ উইথ শম্পা, নয়ন হাব, আপন বোন, এসপি ক্রিয়েশন, রাকিব হোসেনের মতো ব্যক্তিপর্যায়ে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজগুলোর ভিউ, ফ্যান-ফলোয়ার, সাবস্ক্রাইবার ও জনপ্রিয়তার দিকে অগ্রগামী। এই লাইনে যত ভিউ, তত টাকা তত্ত্বটা বেশ কার্যকর। তা ছাড়া কনটেন্টের ভেতরে কোনো পণ্য বা সেবা ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের প্রচার করে অতিরিক্ত অর্থ আয় করা যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও ইউটিউবারকে চিনি, যাঁরা চাকরির পাশাপাশি এসব করেন।

আরও পড়ুন

এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা দেশে বসে ভিডিও কনটেন্ট বানিয়ে যেমন বিদেশি মুদ্রা আয় করছেন, তেমনি বিদেশের মাটিতে বসে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি কনটেন্ট তৈরি করে অর্থ উপার্জন করছেন। সেই অর্থ আবার রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা যেমন কনটেন্ট দেখিয়ে বিদেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে আসছেন, তেমনি বিদেশিরাও বিভিন্ন কনটেন্ট দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। মাসিক, ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক এ খাতে কী পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে আসছে, আবার কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে—এ সংক্রান্ত হিসাব রাখতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সরকার বিভিন্ন আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই সঙ্গে এ খাতে তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে খাতটাকে আরও গতিশীল করার চেষ্টা করা যেতে পারে। বেকার তরুণ-যুবকদের এ খাতে সম্পৃক্ত হতে করা যেতে পারে উদ্বুদ্ধ। বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে ৩০ কোটির ওপরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। সুতরাং, বাংলা ভিডিও কনটেন্টের বাজার নেহাত কম নয়। সম্ভাবনাময় এ খাতে সরকারি উদ্যোগে বেকারদের নিয়োজিত করে কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচন করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

অবশ্য এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে ‘ভিউ পাগলা’ কিছু ইউটিউবার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর সস্তা, নিম্নমান ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও পোস্ট করে অর্থ আয় করেন। আবার কেউ কেউ গুজব ছড়িয়ে সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট করেন অথবা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেন, যা অপরাধ, নীতিনৈতিকতাবিরোধী ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের নিজেদের প্রচেষ্টায় মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নজরদারি যেমন দরকার, আবার নজরদারির নামে যাতে হয়রানি না করা হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। যাঁরা সত্যিকার অর্থে মেধা-বুদ্ধি বিনিয়োগ করে ভালো কনটেন্ট বানিয়ে অর্থ আয় করছেন। কনটেন্ট প্রজন্মের বিপ্লবে নিজেকে শামিল করে ভিন্ন কিছু করছেন। সেই নতুন ধারার বিপ্লবীদের আমরা স্বাগত জানাতে পারি কি?

  • তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
    [email protected]