‘দেহ পাবি মন পাবি না শয়তান’- সমাজ বোঝার জুতসই প্রশ্ন

অগণিত সিনেমায় ব্যবহার করা এ সংলাপ অতি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার ঝড় তুলেছে
ছবি: সংগৃহীত

‘তুই আমার দেহ পাবি, মন পাবি না শয়তান!’

বাংলা সিনেমায় অতি পরিচিত সংলাপ। প্রায়ই দেখা যায়, সিনেমার ভিলেন একা কিংবা দলবল নিয়ে কোনো অসহায় নারীকে ধর্ষণের চেষ্টাকালে নারীটি এ সংলাপ দেন। অগণিত সিনেমায় ব্যবহার করা এ সংলাপ অতি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার ঝড় তুলেছে।

প্রথম আলোর বরাতে জানা যায়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের মিডটার্ম পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ বা ‘শয়তান দেহ পাবি, চিন্তা পাবি না’ উদ্ধৃতি উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। ‘ব্রিটিশ হেজিমনি’র আলোকে সেটির বিস্তারিত বর্ণনা করতে বলা হয় প্রশ্নে। সেই প্রশ্নপত্রের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করার পর পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

নারীদেহ, ধর্ষণ ইত্যাদি নিয়ে আমাদের সমাজে বিপুল পরিমাণ ট্যাবু রয়েছে। এসব নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনাই রীতিমতো নিষিদ্ধ আর গবেষণার তো কথাই নেই। অথচ প্রথমেই মাথায় প্রশ্ন আসে, সংলাপটি বাংলা সিনেমায় এত বেশি জনপ্রিয় হলো কী করে? নিশ্চিতভাবেই এ সংলাপের পটভূমি আমাদের পরিচিত সমাজ। সিনেমার সংলাপ তো আর হাওয়া থেকে আসবে না।

সংলাপটি আর এর সঙ্গে পরিচিত দৃশ্যটি কল্পনা করলে বোঝা যায়, এখানে একজন সম্ভ্রম হারাতে যাওয়া মানুষ তাঁর শেষ একটা প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। এই সমাজে নারীর কাছে সম্ভ্রম হারানোই সব, তাই শেষ প্রতিরোধটা নিষ্ফল জেনেও তিনি একটা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ধর্ষণোদ্যত পুরুষগুলোকে অন্তত এইটুকু অপরাধবোধ দিচ্ছেন যে তিনি কেবলই একটি জড়বস্তু, একটি দেহ। ধর্ষকের কামনা সেখানে জান্তব, যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। অবলার পক্ষে এর বেশি কিছু করার থাকে না।

শিল্প-সংস্কৃতির বেশির ভাগ আলাপের মতো এ সংলাপকেও কিন্তু সমাজের বৃহত্তর মাপে দেখা যায়। রাজনৈতিকভাবে দেখলে, একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অনুরূপ অনুভূতিই হয়। যদিও ধর্ষণের মতো জঘন্য বিষয়ের সঙ্গে শাসকের নিপীড়নকে কেউ কেউ কুরুচিপূর্ণ বলতে পারেন, সেইটুকু দায় মাথায় নিয়েও বলা যায়, অসহায় শোষিতেরা এ রকমভাবে প্রতিরোধ করেন। সব সম্পদ ও ইজ্জত শাসকের পায়ে লুটিয়ে দিলেও মনে মনে শ্রদ্ধাটা করেন না।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
ছবি: প্রথম আলো

উপরিউক্ত প্রশ্নপত্রের উত্তরে এই আলাপগুলো আনা যায়। ব্রিটিশ আমলে আমরা দেখতে পাই, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সব দেশ দখল করে যাবতীয় সম্পদ লুট করলেও ব্রিটিশদের প্রতি অনেকেই পূর্ণ আনুগত্য দেখায়নি। কেউ কেউ বাধ্য হলেও ব্রিটিশকে ঠারেঠুরে বুঝিয়ে দিয়েছে, আমি শারীরিকভাবেই কেবল তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছি, মানসিকভাবে নই।

আদতে, হেজিমনি বা আধিপত্যের বিরুদ্ধে অসহায়ের প্রতিবাদ করার এ এক বৈশ্বিক তরিকা। শাসকও সেটা জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবশ্যকর্তব্য এই চিন্তাগুলোকে ধরতে পারা। কেবল যে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বেলাতেই খাটে তা নয়, এই চিন্তা সাম্রাজ্যবাদ-পরবর্তী জাতীয় শাসকদের বেলাতেও প্রযোজ্য। বরিশালের শিক্ষক এ প্রশ্ন করার জন্য সাধুবাদ পাবেন।

কিন্তু এর চেয়ে বড় উপকার তিনি যেটা করলেন, আমজনতার মনোভাব দেখিয়ে দিলেন। ফেসবুকজুড়ে তীব্র হাসাহাসি, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তো বটেই এমনকি পিএইচডিধারীরা পর্যন্ত এ প্রশ্নকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘অশ্লীল’ বলে।

ওনাদের চিন্তায় ট্যাবু এতটা জায়গা জুড়ে থাকে যে ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তায় ওনারা আর মন দিতে পারেন না।

বাংলা সিনেমার প্রশ্ন আসায়, সিনেমায় অশ্লীলতা ও কাটপিস সংস্কৃতির যুগের কথা মনে হয়। এই সমস্যা আমাদের সিনেমাকে ধ্বংস করার অন্যতম কারণ। আর যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ একে তাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত করতে পারা। অথচ আমাদের অশ্লীল সিনেমা আর কাটপিস নিয়ে তেমন ভালো গবেষণা চোখে পড়ে না। একজন ডাচ নারী লটে হোয়েক এ নিয়ে কাটপিস শিরোনামে ভালো একটি বই লেখেন, দেশিরা সম্ভবত ট্যাবুর ভয়েই চেপে যান।

একাডেমিক গবেষণার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সমাজের নানাবিধ বিষয়কে বিভিন্ন আলোকে দেখা। মানুষ ও সমাজের সবচেয়ে অন্ধকার জায়গাগুলোতে আলো ফেলা এর প্রধান কর্তব্য। এ কারণে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো গবেষক এত বেশি শ্রদ্ধেয়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানবিদ্যার জনক এমিল ডুর্খেইম কাজ করেছিলেন আত্মহত্যার মতো স্পর্শকাতর ব্যাপার নিয়ে।

আমরা মধ্যযুগের ইসলামি দুনিয়ায় চিন্তক ও সৃষ্টিশীলদের এমন সব বিষয় নিয়ে গবেষণা ও তর্ক করতে দেখি, যা তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ইউরোপে ছিল মৃত্যুদণ্ডের মতো অপরাধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আধুনিক যুগে চাকা ঘুরে যায়। সমৃদ্ধি আর প্রগতিও তাই উল্টে যায় দুই ক্ষেত্রে।

বর্তমান দিনে বিগ ডেটা গবেষকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় বিষয়। মার্কিন বিগ ডেটা বিজ্ঞানী সেথ স্টিফেন্স-ডাভিডউইজ তাঁর ‘এভরিবডি লাইজ’ বইয়ে উল্লেখ করেন, মানুষের চরিত্র, আকাঙ্ক্ষা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপাত্তগুলো পাওয়া যায় তাঁর পর্নোগ্রাফি দেখার রুচির ওপর। এর ওপর ভিত্তি করে তিনি মানবচরিত্র নিয়ে সত্যিকারের যে উপাত্ত পান, তা অন্যভাবে পাওয়া সম্ভব হতো না।

অর্থাৎ সোজা বাংলায় সমাজে এবং মানুষের মধ্যে থাকা অন্ধকারতম দিকগুলো নিয়ে কোনো রকম ট্যাবু বা কুসংস্কার ছাড়া আলোচনা করাই একাডেমিশিয়ানের কাজ। যে সমাজ এই কাজগুলো যত ভালোভাবে করতে পারে, সে তত এগিয়ে যায়।

আমরা মধ্যযুগের ইসলামি দুনিয়ায় চিন্তক ও সৃষ্টিশীলদের এমন সব বিষয় নিয়ে গবেষণা ও তর্ক করতে দেখি, যা তখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ইউরোপে ছিল মৃত্যুদণ্ডের মতো অপরাধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আধুনিক যুগে চাকা ঘুরে যায়। সমৃদ্ধি আর প্রগতিও তাই উল্টে যায় দুই ক্ষেত্রে।

একাডেমি আর সমাজচিন্তকদের ব্যাপারটা ভাবা জরুরি। আমাদের তরুণ চিন্তক ও একাডেমিশিয়ানদের সমাজের কুসংস্কার ও ট্যাবুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা শিখতে হবে, নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে আরও বেশি আলোচনা করতে হবে সমাজ ও মানুষকে আরও ভালোভাবে বুঝতে, সমাজকে সংস্কারের পথ দেখাতে।

অশ্লীলতা এড়ানোর নামে সমাজে বিদ্যমান প্রশ্ন আর সমস্যাগুলোকে এড়ানোর উপায় নেই। সমাজের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করা ছাড়া উপায় নেই। বিড়ালের মতো বালুর আড়ালে বিষ্ঠা ঢাকা মানুষের সমাজে সমাধান হতে পারে না।

  • সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক