মুসলিম নারীদের পোশাকেই কেন সরকারি নিয়ন্ত্রণ

মুসলিম নারীরা কী ধরনের পোশাক পরবেন, তা ফরাসি সরকারের কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে

৮ সেপ্টেম্বর, ফ্রান্সের শীর্ষ প্রশাসনিক আদালত সরকারি স্কুলে আবায়া নিষিদ্ধ করে দেওয়া নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দিয়েছে। শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় ‘আবায়া’ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে সরকার গত আগস্টে ‘আবায়া’ নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিল।

পরবর্তী সোমবার, প্রায় ৩শ ছাত্রী স্কুলে আবায়া পরে আসে। তাদের মধ্যে ‘আবায়া’ বদলাতে রাজি না হওয়ায় ৬৭ জনকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার ধুয়া তুলে ফরাসি সরকার এমন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিশানা করা হয়েছে মুসলিম সংখ্যালঘুদের। মুসলিম নারীরা কি ধরনের পোশাক পরবেন তা কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

২০০৪ সালে সরকারি স্কুলগুলোয় প্রথমে হিজাব নিষিদ্ধ হয়। ২০১০ সালে নিষিদ্ধ হয় মুখ ঢাকা হিজাব । ২০১৬ সালে বেশ কিছু পৌরসভা সারা দেহ ঢাকা সাঁতারের পোশাক নিষিদ্ধ করে।

তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী পাপ নডিয়াই নভেম্বর ২০২২ এ লাইসিতি পরিকল্পনা নিয়ে আসেন। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের এমন কোনো পোশাক পরা থেকে বিরত রাখা যা তার ধর্মীয় পরিচয়ের সাক্ষর বহন করে। এমনকি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্কুলগুলোয় নজরদারিতে জোর দেওয়া হয়।

সে সময় কোনো ছাত্রী লম্বা স্কার্ট বা ফুলহাতা জামা পরে এসেছে কি না খুঁজে বের করতে স্কুল কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কেউ অমন পোশাক থেকে সরে না আসলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। এমনকি তাদের স্কুলে ঢোকাও নিষিদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন সময়। তাদের বলা হয়েছে, তাদের আচরণ রাষ্ট্রের যে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র তার জন্য ক্ষতিকর।

মুসলিম নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর নজরদারি এবং রীতিমতো পোশাক খুলে নেওয়াকে যুক্তিযুক্ত বলা হচ্ছে। কারণ এমন একটা প্রচার আছে যে মুসলিম পুরুষেরা জোর করে ইসলামিক পোশাক পরাচ্ছে। ফরাসি সরকারের এসব নীতির পেছনে একটা ধারণা কাজ করে। তারা মনে করে মুসলিম নারী ও কন্যা শিশুরা অসহায়। তাদের মুক্তি প্রয়োজন। কিন্তু এই ধারণার বশবর্তী হয়ে কর্তৃপক্ষ যা করছে তা যে আসলে জবরদস্তি। এটা আবার তারা বুঝতেও চাইছে না।

ধর্মনিরেপক্ষতা নিশ্চিত করতে ফ্রান্স প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্তি এর মূল কথা। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এটা এখন একটা নোংরা ধরনের গোঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে চার্চ কে আলাদা করার উদ্দেশ্য ছিল চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং ধর্মের নামে জবরদস্তি প্রতিহত করা। ফ্রান্সে সরকার যা করছে তার সঙ্গে যে ভাবনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভব তার কোনো মিল নেই।

বরং ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীটি সমাজে আরও প্রান্তিক হয়ে উঠছে, যাদের কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। ফ্রান্সে মুসলিম সম্প্রদায়ের মতো করে আর কোনো সম্প্রদায়কে নিশানা করা হচ্ছে না।

ফরাসি সরকার নিয়মিত ‘ইসলামিস্ট সেপারাটিজম’ (ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ) বলে একটি শব্দ উচ্চারণ করে থাকে। এর অর্থ হলো, মুসলিমরা ফরাসি জাতির প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এবং তারা ফ্রান্সকে আপন ভাবে না। ২০২১ সালে সরকার এই বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রতিহত করতে আইন করে। এতে করে ধর্মীয় প্রতীক নিষিদ্ধ করা, উপাসনার জায়গা মন চাইলেই বন্ধ করে দেওয়াসহ মুসলিম সংগঠনগুলোর পেছনে লেগে থাকার আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

ফরাসি কর্তৃপক্ষ পুরো সম্প্রদায়ের ওপর খড়্গহস্ত, তবে তাদের আক্রমণের মূল শিকার হচ্ছে মূলত নারী ও কন্যা শিশুরা।

স্কার্ট বা অন্য কোনো পোশাকের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তা দিয়ে কিছুই যায় আসে না। যায় আসে যখন কোনো মুসলিম নারী তা গায়ে চড়ান। সঙ্গে সঙ্গে তা ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও আদর্শের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। যদি আগামীকাল কোনো মুসলিম নারী একটা বিশেষ ধরনের কাপড়, একটা টি-শার্ট, কিংবা নতুন ধরনের এক জোড়া জুতো পরেন, ওটাও নিষিদ্ধ করার ছল খুঁজবে সরকার।

মুসলিম নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর নজরদারি এবং রীতিমতো পোশাক খুলে নেওয়াকে যুক্তিযুক্ত বলা হচ্ছে। কারণ এমন একটা প্রচার আছে যে মুসলিম পুরুষেরা জোর করে ইসলামিক পোশাক পরাচ্ছে। ফরাসি সরকারের এসব নীতির পেছনে একটা ধারণা কাজ করে। তারা মনে করে মুসলিম নারী ও কন্যা শিশুরা অসহায়। তাদের মুক্তি প্রয়োজন। কিন্তু এই ধারণার বশবর্তী হয়ে কর্তৃপক্ষ যা করছে তা যে আসলে জবরদস্তি। এটা আবার তারা বুঝতেও চাইছে না।

আরও পড়ুন

মুসলিম নারীদের পোশাকের পছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করার এই চল কিন্তু আজকের নয়। ১৯৫৯ সালে এ ডাইং কলোনিয়ালিজম বইয়ে উপনিবেশবিরোধী চিন্তক ফ্রানজ ফ্যানন বলেছিলেন আলজেরিয়া ফরাসিদের ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখতে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি ছিল। ঘোমটা খুলতে বাধ্য করে তারা আসলে আলজেরিয়ার মানুষের যে মৌলিক সত্তা তাতে আঘাত হানতে চেয়েছিল।

নিজের শরীরের ওপর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার একেবারে ছোট্টবেলায় কেড়ে নিয়ে ফরাসি সরকার একটা বার্তা দিতে চায়। তারা বোঝাতে চায় যে এভাবে তারা শুধু বিরুদ্ধমতকে দমন করতে পারে তা-ই নয়, ইচ্ছে হলেই তাদের স্বাধীনতা দিতে বা কেড়ে নিতে পারে।

বেছে বেছে মুসলিম স্কুলছাত্রদের নিশানা করে আসলে ফ্রান্সের যে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ তাতে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। বরং, এতে করে ছাত্রছাত্রীদের মনে ভীতির সঞ্চার হবে। তারা সমাজের অন্যান্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই ফরাসি কর্তৃপক্ষ যেভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদ ঠেকাতে চাইছে, তাতে হিতে বিপরীত কিছু ঘটার আশঙ্কা আছে।

আরও পড়ুন

কলেক্টিফ কনথা এল ইসলামোফোব এন ইউরোপ (সিসিআইই) একটি অলাভজনক দাতব্য সংস্থা। তারা ইউরোপে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করে থাকে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

সংস্থাটি একজন ফরাসি স্কুলছাত্রীর অভিজ্ঞতার কথা জানায়। তার স্কার্টের ঝুল বেশি মনে হয়েছিল শিক্ষকের। সে কারণে মেয়েটি হয়রানির শিকার হয়। শিক্ষক তাকে স্কার্ট খুলতে বাধ্য করেন, এবং সারা দিন তাকে শুধু লেগিনস পরে থাকতে হয়। স্কুলের কর্মীরা বলতে থাকে পোশাকের পছন্দের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক আছে, যার সঙ্গে ফরাসি শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে জবাই করে হত্যার যোগ আছে। মেয়েটি এই কথায় গভীরভাবে মর্মাহত হয়।

আরও পড়ুন

দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ফরাসি সরকারের এসব নীতি ও বক্তৃতা দেশটিতে ইসলামভীতি ছড়াচ্ছে। সিসিআইই ২০২২ সালে মুসলিম বিরোধী ৫০১ টি ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৮৪। অর্থাৎ এ ধরনের ঘটনার হার এক বছরের মধ্যে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ২০০৪ সালে হিজাব নিষিদ্ধের পর শিক্ষা খাতে ইসলামভীতি সংক্রান্ত ঘটনার সংখ্যা ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। যার প্রধান শিকার ছিল স্কুলের ওপরের ক্লাসে পড়া মেয়েরা।

মুসলিম নারী ও কন্যা শিশুরা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। কিন্তু তারা মুক্তিকামী। তারা ভয়ভীতি ও জবরদস্তিমুক্ত ফ্রান্সে টিকে থাকতে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

  • হেভ জামাল শিক্ষায় বৈষম্য, ইসলাম বিদ্বেষ ও ফিলিস্তিনে দখলদারির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে কাজ করে থাকেন।

    আল জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ।