সিটি করপোরেশনগুলোতে নাগরিক সেবা প্রাপ্তির বিষয়ে অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সর্বোচ্চ আন্তরিক ও যোগ্য হলেও এই সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত বহুমুখী কর্তৃত্বজনিত সমন্বয়হীনতা, আমলাতান্ত্রিক বাধা ও অবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশের নগরগুলো অত্যন্ত দ্রুতবর্ধিষ্ণু, এখনই দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে। ২০৪০ সালে এই হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। জীবিকা ও জীবনোপকরণের আকর্ষণেই এমনটি হচ্ছে। দ্রুত বর্ধিষ্ণু ও ত্রুটিপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। যেখানে জনগণের প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
তা ছাড়া সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর বহুমুখী রাজধানীভিত্তিক প্রশাসন এক সমন্বয়হীন নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এই নগর দুটি শিগগিরই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মোট আয়তন ৩০৬ বর্গ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এর আয়তন ১৫৫ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা নিয়ে সরকারি সূত্রের সঙ্গে বাস্তবতার অনেক ফারাক। যদিও (বিবিএস) যে তথ্য দেয়, তা-ই অফিশিয়াল।
তবে বাস্তবে (জনশ্রুতি/জনমত/গবেষক ও গণমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী) ঢাকা ও চট্টগ্রামের জনসংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধরা হয়। ঢাকার জনসংখ্যা ২ কোটি থেকে ২ দশমিক ২ কোটি বলে ধারণা করা হয়, চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ বলে অনুমান করা হয়। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের সেবাপ্রাপ্তির অবস্থা কিছুটা উল্লেখ করছি।
ঢাকা নগরের বাস্তবতা
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর। এখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজসহ অনেক নাগরিক সেবা দেয় সিটি করপোরেশন। পানি সরবরাহ করে ওয়াসা। বিদ্যুৎ দেয় ডিপিডিসি ও ডেসকো।
গ্যাস দেয় তিতাস, সড়ক ও আবাসন উন্নয়ন করে রাজউক, পরিবহন তদারকি করে বিআরটিএ, আইন প্রয়োগ করে পুলিশ—এমনভাবে নাগরিক সেবায় যুক্ত আছে প্রায় ২৪–২৫টি সংস্থা। প্রতিটি সংস্থা আলাদা মন্ত্রণালয়ের অধীন। ফলে এক কাজ বারবার হয় (রাস্তায় বারবার খোঁড়াখুঁড়ি তারই উদাহরণ)। সড়ক, ড্রেনেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। যানজট, জলাবদ্ধতা ও দূষণ বাড়ে। নাগরিক সেবা হয় জটিল ও অকার্যকর।
এভাবে ঢাকার কোটি মানুষ প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অথচ সংবিধান ও আইন বলছে, শহর পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে থাকার কথা।
চট্টগ্রাম নগরের বাস্তবতা
চট্টগ্রাম দেশের প্রধান বন্দরনগরী ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এখানেও একই সমস্যা—বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা। পানি সরবরাহের দায়িত্বে চট্টগ্রাম ওয়াসা, গ্যাস সরবরাহ করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল), বিদ্যুৎ দেয় পিডিবি, বন্দর পরিচালনা করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, নগর বর্জ্য ও সড়ক সেবা (সড়ক আলোকায়নসহ) দেয় সিটি করপোরেশন। অন্য সিটি করপোরেশনের চেয়ে বাড়তি কিছু কাজ যেমন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সিংহভাগই পরিচালনা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
বন্দরের কারণে সৃষ্ট যানজট, কনটেইনার ট্রাকের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল, ওভার লোডেড যানবাহনের কারণে সড়ক নষ্ট হচ্ছে। বন্দরভিত্তিক অতিরিক্ত মানুষের সমাগম ও তাদের দেওয়া নাগরিক সেবার চাপ সহ্য করতে হচ্ছে সিটি করপোরেশনকে। শিল্পাঞ্চলের দূষণ ও জলাবদ্ধতা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। অথচ বন্দরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে শহরের ভেতর ও বাইরের অবকাঠামো ও সেবার সমন্বয় অপরিহার্য। সেটিই এখন অনুপস্থিত।
২০০৯ সালের সিটি করপোরেশন আইনেও (আগে অর্ডিন্যান্স) সিটি করপোরেশনকে ‘অবিচ্ছিন্ন উত্তরাধিকার ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। আইন ও অর্ডিন্যান্সে নানা ধারা-উপধারায় শর্ত জুড়ে দিয়ে সিটি করপোরেশনকে মন্ত্রণালয় নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে যা স্বশাসনের মৌলিক ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বর্তমান ব্যবস্থায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন আলাদা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় যে অসম্ভব, তা মাত্র একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছি। গত বছর বর্ষার আগে চট্টগ্রামের মেয়র চট্টগ্রামের সব সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে একটি সমন্বয় সভা করেন। সেখানে তিনি অনুরোধ করেন, যেসব সংস্থার উন্নয়নকাজের জন্য সড়ক খুঁড়তে হবে, তাঁরা যেন তা নির্ধারিত সময়ে করেন।
তিনি এ–ও বলেন, পরে সিটি করপোরেশন সড়ক মেরামত করে ফেললে আর সড়ক কাটার অনুমতি দেবে না। কিন্তু বাস্তবে কোনো সংস্থাই কথা রাখতে পারেনি। কারণ, নির্ধারিত সময়ে কারও প্রকল্প অনুমোদন পায়নি, কেউ টেন্ডার করতে পারেনি, কারও অর্থছাড় হয়নি ইত্যাদি।
পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশন সড়ক মেরামত করে ফেললে তখন সংস্থাগুলো সড়ক কাটার অনুমতি চায়। তখন, ‘কেন অনুমতি দিচ্ছেন?’ মেয়রকে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি অনুমতি না দিলে জনগণ যদি পানি না পায়, তার দায়ও সিটি করপোরেশনের ঘাড়ে পড়ে।’
সিটি করপোরেশন ফুটপাত, সড়ক কিংবা খাল দখলমুক্ত করতে চাইলে জেলা প্রশাসন কিংবা পুলিশ বিভাগের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় কখন ম্যাজিস্ট্রেট ও ফোর্স মিলবে। আর্থিক সংগতি ও স্বাধীনতা কোনোটাই সিটি করপোরেশনের নেই। আয় বৃদ্ধি ও অনুদান পাওয়ার বিষয়ও মন্ত্রণালয়ের অধীন। মোটকথা সিটি করপোরেশনগুলোর স্বায়ত্তশাসন অকার্যকর।
সিটি করপোরেশন অর্ডিন্যান্স তৈরি করার সময় কথামালার চাতুর্যে এটিকে অতিমাত্রায় মন্ত্রণালয়নির্ভর ও স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী করে ফেলা হয়েছে।
অথচ বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি করপোরেশনকে আইনিভাবে স্বশাসিত (অটোনোমাস) প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০ অনুসারে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে এবং তাদের প্রশাসনিক, আর্থিক ও নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা থাকবে।
২০০৯ সালের সিটি করপোরেশন আইনেও (আগে অর্ডিন্যান্স) সিটি করপোরেশনকে ‘অবিচ্ছিন্ন উত্তরাধিকার ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। আইন ও অর্ডিন্যান্সে নানা ধারা-উপধারায় শর্ত জুড়ে দিয়ে সিটি করপোরেশনকে মন্ত্রণালয় নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছে যা স্বশাসনের মৌলিক ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
উদাহরণ হিসেবে সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর ধারা ১০০ (২)-এর উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘করপোরেশন কোনো কর, রেট, টোল, ফি বা চার্জ আরোপ করিতে পারিবে, অ্যাজ মে বি প্রেসক্রাইবড্।’ অর্থাৎ, সিটি করপোরেশনকে আইনে কর আরোপের ক্ষমতা দেওয়া হলেও বাস্তবে করের হার, ধরন বা আদায়ের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হলে তা সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধি অনুযায়ী করতে হবে।
এর ফলে কর নির্ধারণে করপোরেশনের স্বাধীনতা থাকে না, প্রতিবারই মন্ত্রণালয়ের অনুমতি বা বিধির অপেক্ষায় থাকতে হয়। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো কার্যকর সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্বের বড় শহরগুলোতে (যেমন লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিও, প্যারিস, সিউল, সাংহাই ইত্যাদি) নির্বাচিত মেয়রের অধীন একীভূত সিটি গভর্নমেন্ট সফলভাবে কাজ করছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি গভর্নমেন্ট হলে সব সেবা এক ছাতার নিচে আসবে, সমন্বিত পরিকল্পনা হবে, সময় ও অর্থের অপচয় কমবে, নাগরিক জবাবদিহি নিশ্চিত হবে, সেবার মান ও জনগণের সন্তুষ্টির মাত্রা বাড়বে।
এখন করণীয় হচ্ছ আইনে পরিবর্তন এনে সংবিধানের মূল চাহিদার পূর্ণ বাস্তবায়ন। এর মাধ্যমে ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে দিতে হবে।
সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯ সংশোধন করে বাজেট অনুমোদনে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি বাতিল, নির্বাহী ক্ষমতা মেয়রের হাতে, সেবাদাতা সংস্থাগুলো সিটি গভর্নমেন্টের অধীনে আনা জরুরি। আর্থিক স্বায়ত্তশাসন আইন সংশোধন করে কর আদায়, বন্ড ইস্যু ও বিদেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহি আইনে নাগরিকদের জন্য বার্ষিক বাজেট ও সেবা পরিকল্পনা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এগুলো করা গেলে এক জানালায় সেবা মিলবে, অর্থাৎ এক জায়গায় অভিযোগ করলেই সমাধান পাওয়া যাবে; সমন্বিত উন্নয়ন হবে, যার মাধ্যমে রাস্তায় বারবার খোঁড়াখুঁড়ি কমবে; মেয়র নাগরিকদের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ হবেন; ঢাকায় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, চট্টগ্রামে বন্দরনির্ভর অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে; জলাবদ্ধতা নিরসন, সবুজায়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে এবং অনলাইন বিল, স্মার্ট ট্রাফিক, ডিজিটাল সেবা নাগরিকদের নাগালে আসবে।
প্রকৃত সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করলে ঢাকার জনঘনত্ব ও সেবাসংকট মোকাবিলা হবে, চট্টগ্রামের বন্দরকেন্দ্রিক সম্ভাবনা ও শিল্পবৃদ্ধি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাবে।
এ মডেল শুধু ঢাকা-চট্টগ্রামের জন্য নয়; রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ সব নগরে প্রয়োগযোগ্য।
দেলোয়ার মজুমদার সাবেক চেয়ারম্যান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি), চট্টগ্রাম কেন্দ্র।