শিশুদের মনের বোঝা বাড়ছে, বড়রা বুঝবে কবে?

ভিড়ের মধ্যে আমি যাঁকে খুঁজছিলাম, সে লাবিব নয়। তারপরও লাবিব এগিয়ে এসে বলে, ‘যাকে খুঁজছেন, আমি তাঁর ফার্স্ট কাজিন, অলমোস্ট লাইক ওউন ব্রাদার। আমাকে বলতে পারেন।’ নারী-পুরুষ আলাদা বসার ব্যবস্থা। যে-ই ঢুকছে, তাকেই দোয়া-দরুদের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লাবিব চট করে আমার সমস্যা বুঝে ফেলে কোথা থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে এসে বলে, ‘হ্যাব ইট, দিস ইজ ইয়োরস।’ আমি পিপাসায় কাতর; ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেটি বুঝল ক্যামনে?

এ দেশে শিশুদের কথা ভেবে বড়রা কোনো আয়োজন সাজায় না। বড়দের প্রয়োজনের কথা ভেবে গোছানো হয়। শিশুরা আসবে, সেটা সবাই জানে, কিন্তু তাদের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই। বড়দের উঁচু চেয়ারেই পা ঝুলিয়ে বসতে হয়, বড়দের পছন্দের খাবার খেতে হয়। আন্তরিক বড়দের (!) কেউ কেউ আবার একান্তই বড়দের জন্য নির্দিষ্ট খাবার পান-জর্দা শিশুদের সাধেন। আসলে মসকরা করেন! এসবের সঙ্গে আপস করে চলতে হয় ছোটদের। তারপরও বড়দের মন পাওয়া কঠিন এসব ‘বাই দ্য অ্যাডাল্ট, ফর দ্য অ্যাডাল্ট, অব দ্য অ্যাডাল্ট’ সামাজিক অনুষ্ঠানে।

বড়রা চান, শিশুরা তাঁদের মতোই আচরণ করুক। বসে থাকুক গম্ভীর হয়ে। শিশুসুলভ চপলতা, ছোটাছুটি একেবারেই নয়। বড়রা প্রশ্ন করলে উত্তর দেবে; নিজেরা কোনো প্রশ্ন করবে না। এত সব আচরণের ঘেরাটোপের মধ্যেও লাবিবের সঙ্গে আমার জমে যায়। পড়াশোনা, নম্বর, এ প্লাস, বি প্লাস, অ্যাম্বিশন এসব নিয়ে প্রশ্ন না করে আমরা আড্ডায় মেতে উঠি। ফুল, পাখি, ঠান্ডা, গরম, ঝড়, বৃষ্টি, চাঁদ, পূর্ণিমা, আইসক্রিম, পায়েস, খাওয়াদাওয়া, দেশ, পরদেশ, ভ্রমণ, পার্ক, বাগান, গাছপালা নিয়ে আমাদের আড্ডা এগিয়ে চলে। মাঝেমধ্যে লাবিবের অভিভাবকেরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে যায় তার গতি ও অবস্থান। ঠাওর করতে পারে না, যে লাবিব বাড়িতে চুপচাপ, সে একজন প্রায় অপরিচিত বুড়ার সঙ্গে কী এত কথা বলছে হেসে হেসে! কেউ কেউ গলা নামিয়ে বলেন, ‘আঙ্কেলকে বিরক্ত করছ না তো?’ আড্ডার মধ্যেই লাবিব উঠে গিয়ে জামবাটিতে রাখা খুরমা আর টিস্যু পেপার নিয়ে আসে আমার জন্য। বড়রা যখন খুরমা খেয়ে বীজ আর টিস্যু এদিক-ওদিক ফেলছেন, তখন লাবিব জাপানিদের মতো দূরে রাখা বিনের মধ্যে ফেলে আসে সেগুলো। আমি বলি, ‘আরিগাতোগুজাইমাস’। ‘তুমি জাপানি জানো?’ আমি বলি, ‘ওইটুকুই জানি।’ লাবিবদের স্কুলে একজন জাপানি মিস আছেন, বিজ্ঞান টিচার। তাঁর কাছ থেকে নিজের গরজে লাবিবের শেখা।

এগারো বছরের শফি কেন চলে গেল?

পিরোজপুরের নেছারাবাদের শফিকুল ইসলাম ‘গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা’ করে নভেম্বরের ২০ তারিখে। কে জানে, কোন স্ট্রেসের হাত থেকে নাজাত পেতে চেয়েছিল সে। সন্ধ্যার দিকে মা ঘরে ঢুকে দেখেন, তাঁর আদরের ধন শফিকুল ঘরের আড়ার সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে আছে। শিক্ষকেরা বলছেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের একজন নিয়মিত ছাত্র। সে সুস্থ মস্তিষ্কের এবং বেশ নম্র-ভদ্র ছেলে ছিল। তার গলায় ফাঁসের কথা মেনে নেওয়া একপ্রকার অবিশ্বাস্য ব্যাপার।’ কারোরই জানা নেই, কারণটা কী ছিল। তবে সে যে একটা চাপের মধ্যে ছিল, তাতে কোনো ভুল নেই।

আরও পড়ুন

প্রবণতা বাড়ছে

এ বছর সেপ্টেম্বরে (৯ সেপ্টেম্বর ২০২২) একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা থেকে জানা যায়, দেশে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬৪ শিশু আত্মহত্যা করেছে। এর ভেতর ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৯৪ জনই ছিল স্কুলগামী শিক্ষার্থী। এ সময় মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীর মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও ছিল ৪৪ জন। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪৫ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সমীক্ষাটি আরও জানায়, এককভাবে ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। আত্মহত্যা করা ৩৬৪ জনের মধ্যে ১৬০ জনই ছিল এই বয়সের।

এর আগে ২০১৯ সালে প্রকাশিত শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে আত্মহত্যায় নিহত শিশুর সংখ্যা ছিল ২১৩। পরের বছর ২০১৮ সালে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ২৯৮-এ, অর্থাৎ সংখ্যার বিচারে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায় ৩৯ দশমিক ৯১ শতাংশে। এরপর করোনাসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি আর শিশুদের প্রতি নানা অজুহাতে আমাদের অবহেলাও বাড়ছে।

উপায় কী

‘চাইল্ডহুড ডিপ্রেশন’ বা বিষণ্ন শৈশব যেকোনো বয়সী শিশুকে গ্রাস করতে পারে। খুব কম শিশুই আছে, যারা তাদের অনুভূতির কথা অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলতে পারে।

তাই শিশু মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছে কি না, তা জানতে তার ওপর নির্ভর না করে কিছু আলামত দেখে বুঝে নেওয়া যায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী এলকিন মনে করেন, বড় কোনো বিপদ এড়াতে হলে শিশুদের মানসিক অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে হবে। তাঁর মতে, একটা যাচাই বা স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে করণীয়গুলো ঠিক করা সহজ হয়। সাধারণত যেসব লক্ষণ দেখে পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ বা অনুমান করা যায় বলে মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা সেগুলো হচ্ছে, ১. হঠাৎ পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়ে যাওয়া, ২. সময়মতো ঘুমিয়েও ক্লান্ত অনুভব করা, ৩. নিজেকে অপদার্থ মনে করতে শুরু করা, ৪. ঘরকুনো হয়ে যাওয়া, ৫. মজার পরিকল্পনায় অংশ না নেওয়া, ৬. স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কান্নাকাটি করা, ৭. আনন্দের উপলক্ষগুলো উপভোগ না করা, ৮. ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া, ৯. সাহায্য নিতে না পারা, ১০. কথাবার্তায় দুশ্চিন্তা ফুটে ওঠা ইত্যাদি।

মোদ্দাকথা, শিশুদের সময় দিতে হবে। তাদের মনের কথা শুনতে হবে। অনেক সময়ই অভিভাবকেরা মনে করেন, খেলনা আর শখের সামগ্রী পেলেই শিশু খুশি থাকবে।

মনোবিদেরা বলছেন, অনেক শিশুই সব কথা মন খুলে বলতে পারে না। সে ক্ষেত্রে বড়দের অনেক কথাই তাদের মনের গভীরে ক্ষত সৃষ্টি করে। সন্তানকে কোন কথা কীভাবে বললে তাতে তার মনে আঘাত লাগবে না, তা জানতে হবে অভিভাবককেই।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: nayeem 5508 @gmail. com