নতুন বাংলা পাঠ্যবইয়ে নারী লেখকেরা কোথায়

২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে এসেছে নতুন কারিকুলামের ভিত্তিতে রচিত নতুন পাঠ্যবই। প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কারিকুলাম রিভিউ করা হয়েছে এবং নতুন কারিকুলামের ভিত্তিতে নতুন বই প্রণয়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। গত বছর কিছু স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন বই চালু করা হলেও এ বছরই প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর জন্য নতুন কারিকুলামের ভিত্তিতে রচিত নতুন বই সরবরাহ করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যেহেতু সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাই খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে কী আছে, তা জানার জন্য। অবশেষে হাতে এল নতুন বই দুটি।

নতুন শিক্ষাপদ্ধতির কারণে আগের মতো বাংলা প্রথম পত্র ও বাংলা দ্বিতীয় পত্রের জন্য আলাদা বই নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র মিলিয়েই করা হয়েছে একটি বই। সাহিত্য, ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব মিলিয়ে যেহেতু একটি বই করা হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ইত্যাদির আধিক্য কমে গেছে। সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে তথ্যমূলক লেখা, কল্পনানির্ভর লেখা, বিশ্লেষণমূলক লেখার উদাহরণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাহিত্যের প্রায়োগিক এ উপস্থাপন ভালো লেগেছে। এর পাশাপাশি ‘সাহিত্য পড়ি লিখতে শিখি’ নামে যে অংশটি আছে, সেখানেও একটি করে কবিতা, ছড়া, গান, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

তবে পুরো এ আয়োজনে প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে নারী সাহিত্যিকদের অনুপস্থিতি। প্রথমেই আসা যাক ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, রোকনুজ্জামান খান, মমতাজউদদীন আহমদ, সুকুমার রায়, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল্লাহ আল মুতী, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, জসীমউদ্‌দীন, শামসুর রাহমান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হ‌ুমায়ূন আহমেদ, কামরুল হাসানসহ মোট ১৩ জন পুরুষ সাহিত্যিকের বিপরীতে মাত্র দুজন নারী—জাহানারা ইমাম ও সেলিনা হোসেনকে খুঁজে পাওয়া যায়; শতকরা হিসাবে যা মাত্র ১৩.৩ শতাংশ। ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ‘চারুপাঠ’ নামে যে বাংলা বইটি প্রচলিত ছিল, তাতে ১৭টি গদ্য ও পদ্যের মধ্যে মাত্র দুটির লেখক ছিলেন নারী।
সপ্তম শ্রেণির বইয়ের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সপ্তম শ্রেণির বাংলা পাঠ্য বইয়ের ১৫০ পৃষ্ঠা পার করলেও চোখে পড়েনি কোনো নারী লেখকের উপস্থিতি। অবশেষে ১৫৪ নম্বর পৃষ্ঠায় একমাত্র নারী লেখক হিসেবে হালিমা খাতুনের লেখার দেখা পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।

আরও পড়ুন

সপ্তম শ্রেণির পুরো বাংলা বইয়ে হালিমা খাতুনের ‘আষাঢ়ের এক রাতে’ গল্পটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বিপরীতে যে পুরুষ সাহিত্যিকদের দেখা পেয়েছে শিক্ষার্থীরা, তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হক, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ মুজতবা আলী, গোলাম মুরশিদ, আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বন্দে আলী মিয়া, আল মাহমুদ, অন্নদাশঙ্কর রায়, শওকত ওসমান, শামসুজ্জামান খান ও মামুনুর রশীদ। এমনকি চিঠি ও ডায়েরি লেখার উদাহরণ হিসেবে ৭২ নম্বর পৃষ্ঠায় একাত্তরের রণাঙ্গন থেকে লেখা যেই চিঠিটি যুক্ত করা হয়েছে, সেটির লেখকও একজন পুরুষ—ফেরদৌস কামাল উদ্দীন মাহমুদ। ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সপ্তম শ্রেণির জন্য ‘সপ্তবর্ণা’ নামে যে বাংলা বইটি প্রচলিত ছিল, তাতে ২০টি বিষয়বস্তুর মাত্র তিনটির লেখক ছিলেন নারী; শতাংশের বিচারে যা মাত্র ১৫ শতাংশ। নতুন পাঠ্যবইয়ে তা নেমে এসেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশে।

প্রথম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ের বিশ্লেষণে আগেই জানিয়েছি, বাংলা পাঠ্যবইয়ে একমাত্র সুফিয়া কামালকেই খুঁজে পেয়েছে শিশুরা। সুফিয়া কামালের বিপরীতে পুরুষ কবি হিসেবে শিশুরা পেয়েছে শামসুর রাহমান, জসীমউদ্‌দীন ও কাজী নজরুল ইসলামকে।

আমার মনে হয়, পাঠ্যপুস্তকে নারীর লেখার শূন্যতার পেছনে শুধু গুণগত মান নয়, বরং দায়ী আমাদের মানসিকতা। সাহিত্যে নারীর সীমিত উপস্থিতির পেছনে দায়ী মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এ সমাজব্যবস্থা সাহিত্যে নারীর উপস্থিতিকে জানান দিতে নারাজ। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যে নারীর উপস্থিতি নিয়েও চলে রাজনীতি। এমনকি এ রাজনীতি দৃশ্যমান সাহিত্যের জাতীয় পদকের মঞ্চ পর্যন্ত। পাঠ্যপুস্তকও এর ব্যতিক্রম নয়।

বাংলা পাঠ্যবইয়ে এত কম নারী লেখকের উপস্থিতির বিষয়টি সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। যাঁরা বই রচনা কমিটিতে থাকেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে আদৌ ভাবেন কি না, আমার জানা নেই। এ ধরনের প্রশ্ন তুললেই যে ধরনের উত্তরগুলো পাওয়া যায়, তা হলো সাহিত্যে নারীর উপস্থিতি পুরুষের তুলনায় অনেক কম, নারীর সৃষ্ট সাহিত্য গুণগত–মানসম্পন্ন নয়, নারীর লেখা সাহিত্য আটপৌরে, দুর্বল ইত্যাদি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাহিত্যে নারীর বিচরণ শুরু হয়েছে পুরুষের অনেক পরে। নানা ধরনের ঘাত–প্রতিঘাত সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলেছে নারীর সাহিত্যযাত্রা। নারীর রচিত প্রতিটি বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পেছনে আছে নারীর ত্যাগ আর সংগ্রামের ইতিহাস।

চন্দ্রাবতী থেকে শুরু করে নওয়াব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, শামসুন নাহার মাহমুদ, নূরজাহান বেগম, নীলিমা ইব্রাহিম, সেলিনা হোসেন, রাবেয়া খাতুন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, তসলিমা নাসরিন, নাসরীন জাহানের মতো প্রতিভারা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েও জন্ম দিয়েছেন গুণগত–মানসম্পন্ন অনন্য সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে তাঁদের সৃষ্টি অনেক বড় জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে তার প্রতিফলন কোথায়? ফলে নারীর অবদানের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সামনে আসছে না। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম কিংবা সেলিনা হোসেনের কিছু লেখা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বটে, কিন্তু নারীর লেখা সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব পায়নি। পাঠ্যবইয়ে অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে নারী রচিত অনেক গুণগত মানসম্পন্ন সাহিত্যকর্ম।

আমার মনে হয়, পাঠ্যপুস্তকে নারীর লেখার শূন্যতার পেছনে শুধু গুণগত মান নয়, বরং দায়ী আমাদের মানসিকতা। সাহিত্যে নারীর সীমিত উপস্থিতির পেছনে দায়ী মূলত রাষ্ট্রব্যবস্থা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এ সমাজব্যবস্থা সাহিত্যে নারীর উপস্থিতিকে জানান দিতে নারাজ। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যে নারীর উপস্থিতি নিয়েও চলে রাজনীতি। এমনকি এ রাজনীতি দৃশ্যমান সাহিত্যের জাতীয় পদকের মঞ্চ পর্যন্ত। পাঠ্যপুস্তকও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু নির্দিষ্ট কবি–সাহিত্যিকদের রচনা গুণগত মানের বিচারে প্রায় প্রতিটি শ্রেণিতেই ঘুরেফিরে এলেও এই একই গুণের মানদণ্ডে ধরা পড়ে না নারীদের রচিত অনেক মূল্যবান সাহিত্যকর্ম।

বর্তমান সাহিত্যধারায়ও দেখা মেলে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল নারী লেখকের। সমতার ভারসাম্য আনতে তাঁদের ভালো মানের সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে পাঠ্যবইয়ে। আমার কিশোর ছেলেটি বাংলা বই পড়তে গিয়ে যখন আমাকে প্রশ্ন করে, ‘বাংলা সাহিত্যে নারীর অংশগ্রহণ এত কম কেন?’ তখন সেই প্রশ্নের উত্তর কী দেব, তা পুস্তক রচনা কমিটি বা সংশ্লিষ্ট কেউ আমাকে শিখিয়ে দেবেন কি?’

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
    [email protected]