প্রথম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ে নারী-পুরুষের চিত্রায়ণ

মনে পড়ে, ২০১৯ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও বিজ্ঞান বইগুলো জেন্ডার লেন্সে বিশ্লেষণ করেছিলাম, যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোতে। আমরা জানি, প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কারিকুলাম রিভিউ করা হয়েছে এবং নতুন কারিকুলামের ভিত্তিতে প্রণীত হচ্ছে নতুন বই।

গত বছর কিছু স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন বই চালু করা হলেও এ বছরই প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন কারিকুলামের ভিত্তিতে রচিত নতুন বই সরবরাহ করা হয়েছে।

খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, কী আছে নতুন বইয়ে? নারী-পুরুষ ও ভিন্ন লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষকে চিত্রায়ণ করার ক্ষেত্রে আগের অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা বোঝার জন্য প্রথমেই হাতে নিয়েছিলাম প্রথম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক বই তিনটি।

প্রথম শ্রেণির আগের বইগুলো এর আগেও মোটামুটিভাবে জেন্ডার সংবেদনশীল ছিল পরবর্তী শ্রেণির বইগুলোর তুলনায়। এ বছর এ ক্ষেত্রে আরেক ধাপ উন্নতি হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বাংলা বইয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি পাতার ছবিতে ছেলে ও মেয়েশিশুর সমান উপস্থিতি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলছে, পড়ছে, স্কুলে যাচ্ছে, সংলাপে অংশ নিচ্ছে।

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী কিংবা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা বইয়ের সংলাপে এবং বইয়ের ছবিতে দৃশ্যমান হয়েছে। তবে নারী ও পুরুষের ভূমিকা চিত্রায়ণে এখনো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি পুরোপুরিভাবে। রাখাল, বাউল, কৃষক, মাঝি, গাছি, পথচারী, গাড়োয়ান ইত্যাদি নানা ভূমিকায় পুরুষকে দেখা গেলেও নারীকে নতুন বউ কিংবা গৃহিণী হিসেবেই খুঁজে পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।

ক্ষমতায়িত নারীর একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন ‘খুশি আপা’ নামে একজন শ্রেণিশিক্ষক। প্রথম শ্রেণির তিনটি বইয়েই নারী বারবার শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ইংরেজি বইয়ের প্রায় প্রতিটি পাতায় নারী শিক্ষকের উপস্থিতির বিপরীতে মাত্র দুবার পুরুষ শিক্ষকের দেখা পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। বরাবরই দেখা গেছে পাঠ্যবইয়ে নারীর পেশা নির্বাচনের বেলায় শিক্ষকতাকেই তুলে ধরতে পছন্দ করেন বইয়ের রচয়িতারা। এর কারণ কি প্রাথমিক শিক্ষায় নারী শিক্ষকের অধিক অংশগ্রহণের বাস্তবতা, নাকি শিক্ষকতা পেশায় নারীর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পুরোনো সংস্কার, তা বলা কঠিন। অন্যদিকে চারদিকে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের জয়জয়কার ধ্বনিত হলেও ১১ সংখ্যা চেনানোর জন্য বইয়ের পাতায় সেই পুরুষ ফুটবল দলের ছবিই স্থান পেয়েছে।

যেসব বই ভবিষ্যতে শিশুদের হাতে পৌঁছানোর কাজ চলছে, সেসব বই যেন আরও বেশি জেন্ডার সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে চূড়ান্ত করার জোর দাবি জানাই। এ ছাড়া বইয়ের পাতায় শিশুরা যেন ভিন্ন লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষগুলোকে খুঁজে পায় এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, সে ক্ষেত্রেও সংবেদনশীল ও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

বাংলা বইয়ের পাঠ-৪৫, সাত দিনের কথায় রাফিকে অনেক ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলেও ঘর-গৃহস্থালির কোনো কাজে তাকে নিয়োজিত করা হয়নি। অথচ এ ধরনের কাজে ছেলেশিশুর অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুমনে নারী-পুরুষের প্রথাগত কাজকে চ্যালেঞ্জ করার পটভূমি রচিত হতে পারত। তাই এ ধরনের সুযোগগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রথম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে নারী কবি হিসেবে একমাত্র সুফিয়া কামালকেই খুঁজে পেয়েছে শিশুরা। সুফিয়া কামালের বিপরীতে পুরুষ কবি হিসেবে শিশুরা পেয়েছে শামসুর রাহমান, জসীমউদ্‌দীন ও কাজী নজরুল ইসলামকে। পাঠ-৫১ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ে’ও শিশুরা পেয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

প্রথম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের অলংকরণে ছেলে ও মেয়েকে সমানভাবে দেখানোর চেষ্টা পরিলক্ষিত হলেও যেকোনো কাজে নেতৃত্বদানকারী হিসেবে পুরুষের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। ছেলে ও মেয়েকে একসঙ্গে খেলতে দেখা গেলেও ফুটবলের নিয়ন্ত্রণ, ক্রিকেটের ব্যাট কিংবা বল হাতে সক্রিয় ছিল পুরুষ। খেলায় ও পেশায় পুরুষের সহায়ক ভূমিকায় ছিল নারী। অর্থ উপার্জনের নানা ভূমিকায় পুরুষকে দেখা গেছে।

কিন্তু নারীকে কেবল ঘর-গৃহস্থালির কাজেই খুঁজে পাওয়া গেছে। ইংরেজি বইয়ের ৪৫ নম্বর পাতায় একটি মেয়েশিশুকে উঠানে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল-কুকুরকে খেতে দিচ্ছে এমন ভূমিকায় দেখা গেলেও ছেলেশিশুকে ঘর-গৃহস্থালির কাজে উৎসাহিত করার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। প্রচেষ্টা ছিল না শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী কিংবা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে, যা বাংলা বইয়ে অনেকটাই স্পষ্ট।

ইংরেজি বইয়ের অলংকরণ যথেষ্ট আধুনিক ও প্রাঞ্জল মনে হয়েছে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে গিয়ে ছবিগুলোকে কখনো কখনো ভিনদেশি ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। যেমন ৪৮ নম্বর পৃষ্ঠার ছবিতে গরু ও উট পাখির সহাবস্থান বাংলাদেশের চেনা বাস্তবতায় একেবারে অচেনা ঠেকেছে।

পরিশেষে বইয়ের পেছনের ন্যাশনাল হেল্পলাইন নম্বর ১০৯ ও ৩৩৩ জুড়ে দেওয়ার বিষয়টি প্রশংসনীয়, যা আগের বইগুলোতেও যুক্ত ছিল। তবে অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই নম্বরগুলো মলাটের আড়ালেই ঢাকা পড়ে যায়। তাই এ নম্বরগুলো বইয়ের পেছনে জুড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়।

অনেকেই অভিযোগ করেন, জেন্ডার বিশ্লেষণে বিশ্লেষণকারীর নাকি জোর করে নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা দৃশ্যমান করার প্রয়াস থাকে। তাই সে ধরনের মন্তব্যগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই বলতে চাই, এসব বৈষম্য এতটাই প্রকটভাবে আমাদের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসে আছে যে তা আমাদের অভ্যস্ত চোখে অনেক সময় ধরা পড়ে না এবং নিজের অজান্তেই সেসব বৈষম্যকে আমরা বইয়ের পাতাতেও স্বীকৃতি দিয়ে ফেলি। তাই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে তা অনেক সময়ই বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বিষয়গুলো লক্ষ করি না কিংবা লক্ষ করলেও এড়িয়ে যাই। কিন্তু এর প্রভাব রয়ে যায় শিশুমনে।

আরও পড়ুন

আমরা মানি আর না মানি সত্য এই যে শিশুদের চেয়ে বড় পর্যবেক্ষক আর কেউ নেই। তাই সমতা প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে পাঠ্যপুস্তকের সামান্য উদাসীনতা শিশুর কোমল মনকে ভাবতে শেখায়, নারী-পুরুষ সমান নয়; এক নয় তাদের সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা।

তাই যেসব বই ভবিষ্যতে শিশুদের হাতে পৌঁছানোর কাজ চলছে, সেসব বই যেন আরও বেশি জেন্ডার সংবেদনশীল হয়ে ওঠে, তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে চূড়ান্ত করার জোর দাবি জানাই। এ ছাড়া বইয়ের পাতায় শিশুরা যেন ভিন্ন লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষগুলোকে খুঁজে পায় এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, সে ক্ষেত্রেও সংবেদনশীল ও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী

[email protected]