নতুন পাঠ্যপুস্তকে কি গাইড বইয়ের ব্যবসা শেষ?

নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইগুলো কেমন হচ্ছে, তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে সবার মধ্যে। বিশেষ করে কিছু প্রকাশনীর মধ্যে, যারা গাইড বই বা সহায়ক বই তৈরি করে। তাদের মধ্যে কিছুটা উৎকণ্ঠাও কাজ করছে। কারণ, এবার শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি আগের মতো থাকছে না।

থাকছে না গতানুগতিক ধারার পরীক্ষাপদ্ধতি, জিপিএনির্ভর ফলাফলও। ফলে তারা ভেবে পাচ্ছে না, কোন কাঠামোয় গাইড বই তৈরি করবে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজে জড়িত থাকার কারণে নামে-বেনামে অনেক প্রকাশনীর ফোন পেয়েছি। তাদের কথা শুনে বুঝতে পারি, নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদানের প্রক্রিয়া তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাদের স্রেফ জানিয়ে দিয়েছি, নতুন মূল্যায়নপদ্ধতিতে গতানুগতিক ধারার গাইড বই শিক্ষার্থীদের কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না।

তাহলে কি গাইড বইয়ের দিন ফুরাল? মোটেই তা নয়। টেক্সট বুক বোর্ডের ‘চরম গোপনীয়তা’ সত্ত্বেও এত দিনে নিশ্চয় তাদের হাতে পাঠ্যবইয়ের কপি পৌঁছে গেছে! ধারণা করা যায়, এসব প্রকাশনীর কাজের যে বিস্ময়কর গতি, তাতে তারা পাঠ্যবইয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাইড বই বাজারে নিয়ে আসবে। এসব গাইড না দেখেও বলে দেওয়া যায়, সেগুলো শিক্ষাব্যবস্থায় মোটেও সুফল বয়ে আনবে না। তবে কোন উপায়ে ভালো সহায়ক বই তৈরি করা যায়, এর কিছু ইঙ্গিত এই লেখায় দিতে চাই।

গাইড প্রকাশকেরা আগে প্রতিটি বিষয়ের জন্য একটি করে গাইড বই তৈরি করতেন। সেটির বদলে এখন প্রয়োজন বুঝে তৈরি করতে পারেন পাঠ-সহায়ক বই। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এসব বইয়ের চাহিদা তৈরি হবে

শিক্ষার্থীরা মূল বই না পড়ে গাইড বই থেকে উত্তর মুখস্থ করে। কথা হচ্ছে, পরীক্ষার প্রশ্ন যদি এমন হয়, গাইড বই মুখস্থ করেই জিপিএ-৫ পাওয়া যায়, তবে কেন একজন শিক্ষার্থী মূল বই খুলে দেখবে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক নিজেও বই খুলে পড়ান না। এমনকি শিক্ষকের কাছে ‘প্রাইভেট’ পড়তে গেলেও পাঠ্যবই খুলতে হয় না। প্রাইভেটে শিক্ষক তাঁর ‘উচ্চমান’-এর নোট তুলে দেন শিক্ষার্থীদের হাতে। তা দিয়েই শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পেয়ে যায়। তাহলে গাইড বই যদি ক্ষতিকর হয়, তবে শিক্ষকের তৈরি করা নোট ভালো হয় কীভাবে? সেটি বরং আরও বেশি ক্ষতিকর। কারণ, সেখানে শিক্ষকের নির্দেশনায় পরীক্ষার জন্য কিছু বাছাই করা উত্তর মুখস্থ করতে হয়।

গাইড বই বরং গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ। অনেক অভিভাবকের আর্থিক সংগতি নেই সারা বছর ধরে শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ানোর। তিনি সন্তানের হাতে একটি গাইড বই তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করেন। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের সময় যারা স্কুলে ভালো করত, তারা গাইড বই অনুসরণ করত না।

তারা নিজেরা উত্তর লেখার পর গাইড থেকে দেখে নিত, সেখানে কীভাবে উত্তরটি উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার কোনো অঙ্কের উত্তর না মিললে গাইড দেখে তারা বুঝে নিত হিসাব করতে ভুল হলো, নাকি নিয়মে কোনো ভুল হলো। একাধিক গাইড থাকলে দেখে নিত অঙ্কটি করার বিকল্প কোনো উপায় আছে কি না।

আরও পড়ুন

গাইড বই ভালো কি মন্দ, এই প্রশ্ন এখন অবান্তর। কারণ, নতুন শিক্ষাক্রমে গাইডে দেওয়া উত্তর কোনো কাজে আসবে না। এখন শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীর দুর্বলতা শনাক্ত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। শ্রেণির নানা কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বাজারে কিছু শিক্ষাসহায়ক বই থাকলে মন্দ হয় না। বইগুলো কেমন হতে পারে, উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক।

বাংলা বিষয়ের জন্য একটি যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রমিত ভাষায় যোগাযোগ করতে পারা। এই দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রতিটি শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ভিন্ন কিছু অনুশীলন থাকছে। বছরজুড়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন-দুর্বলতা চিহ্নিত করা হবে এবং তা পূরণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অর্থাৎ, এখন পরীক্ষা হবে নম্বর দেওয়ার জন্য নয়, বরং শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করার জন্য। তা ছাড়া বছরে দুটি সামষ্টিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকছে।

এর মাধ্যমে উৎসবের মতো করে তাদের দক্ষতাগুলো যাচাই করা হবে। সেই উৎসবে সব শিক্ষার্থী তাদের পছন্দমতো কবিতা আবৃত্তি করে বা নির্বাচিত গদ্য পাঠ করে তাদের দক্ষতার পরিচয় দেবে। গাইড-প্রকাশকেরা এ ক্ষেত্রে কবিতা বা গল্প-প্রবন্ধের সংকলন বের করতে পারেন। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দসই লেখা বাছাই করে নিতে পারবে। তৈরি করা যেতে পারে প্রতিটি শ্রেণির জন্য আলাদা করে অভিধান। এই অভিধানে ওই শ্রেণির সব পাঠ্যবইয়ের কঠিন শব্দগুলোর অর্থ ও প্রয়োগ দেওয়া থাকবে।

গণিতের সহায়ক বইয়ে অঙ্কের সমাধান না দিয়ে অঙ্ক করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা থাকতে পারে। বাস্তব জীবনের সঙ্গে গণিতের সম্পর্ক কী, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে না। বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে সহায়ক বইয়ে এগুলো দেখানো যায়। গণিতের ইতিহাস, গণিতের ধাঁধা—এ ধরনের বই তৈরি করেও গণিতের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা যায়। আবার বিজ্ঞানের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছে কঠিন মনে হয়। কারণ, আমাদের দেশে বিজ্ঞানও প্রায় মুখস্থ করার বিষয় হয়ে গেছে। অথচ আশপাশের সহজ উপকরণ দিয়ে বিজ্ঞানের অনেক পরীক্ষা হাতে-কলমে করে দেখানো যায়। বিজ্ঞানের সহায়ক বই এ রকম পরীক্ষার নমুনা তুলে ধরতে পারে।

গাইড প্রকাশকেরা আগে প্রতিটি বিষয়ের জন্য একটি করে গাইড বই তৈরি করতেন। সেটির বদলে এখন প্রয়োজন বুঝে তৈরি করতে পারেন পাঠ-সহায়ক বই। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে এসব বইয়ের চাহিদা তৈরি হবে। তা ছাড়া বইগুলো এমন হবে, যাতে একটি সহায়ক বই একাধিক শ্রেণির জন্য উপযোগী হয়। তবে এসব বই কেনার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা যাবে না।

বইয়ের মান বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই এ ধরনের বইয়ের অনেকগুলো কপি কিনে প্রতিটি শ্রেণিতে ক্লাসরুম লাইব্রেরি তৈরি করে দিতে পারে। সেখান থেকে ছাত্রছাত্রীরা নেড়েচেড়ে এসব বই দেখতে পারবে, পড়তে পারবে এবং নিজের দক্ষতা বাড়ানোর পথে এগিয়ে যেতে পারবে।

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক