চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, পশ্চিমাদের নিজেদের মাঝেই কেন গভীর বিভক্তি?

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সাম্প্রতিক চীন সফর এ ইস্যুতে সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা
ছবি : রয়টার্স

ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল গত বৃহস্পতিবার বেইজিং সফরে যান। সি চিন পিংয়ের সঙ্গে পশ্চিমা নেতাদের সাক্ষাতের মিছিল যুক্ত হওয়া সর্বশেষ ব্যক্তি তিনি। এ বছরই সি চিন পিং কমিউনিস্ট পার্টি ও দেশে তাঁর নেতৃত্ব সুসংহত করেছেন। মাও সে-তুংয়ের পরে চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক এখন তিনি।

এ বছরের শুরুর দিকে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকের আসরে কমপক্ষে ২০টি দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সি চিন পিং। এসব দেশের কোনোটাই গণতান্ত্রিক দেশ নয়। ইউরোপের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ মিশেলের এই সফর থেকে একটি ইঙ্গিত স্পষ্ট হচ্ছে, চীনের প্রতি পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ইতিবাচক বদল হচ্ছে। আবার বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, সেই ইস্যুতে পশ্চিমাদের মধ্যে গভীর বিভক্তির বিষয়টিও তাঁর এই সফরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

প্রথম বিভক্তিটা আটলান্টিক মহাসাগরের এপার-ওপারকে কেন্দ্র করে। এটা সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি-২০ সম্মেলনের আগে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন তাতে ওয়াশিংটনের সমঝোতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানি) থেকে চীনের প্রতি ওয়াশিংটনের অবস্থান অত্যন্ত কট্টর।

গত অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ হয়। সেখানে বলা হয়েছে, চীনই ‘একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী, যাদের বিশ্বব্যবস্থা বদলে দেওয়ার অভিপ্রায় রয়েছে এবং সেটা করার জন্য তারা আরও অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তি বৃদ্ধি করছে।’ এর ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতি স্থায়ী প্রতিযোগিতা বজায় রাখা এখন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার।

এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি মার্সিডিজ বেঞ্জের প্রধান নির্বাহী ওলা কায়েলিনিউইয়াস বলেছেন, চীনের বাজার থেকে বের হয়ে আসা চূড়ান্তভাবে অকল্পনীয় ব্যাপার। গাড়ি নির্মাণকারী ভক্সওয়াগন, বিএমডব্লিউ এবং রাসায়নিক ব্যবসার বিশাল প্রতিষ্ঠানও একই অবস্থান ব্যক্ত করেছে। মার্সিডিজ বেঞ্জসহ এই চারটি প্রতিষ্ঠান ইউরোপ থেকে চীনে যে বিনিয়োগ হয়, তার তিন ভাগের এক ভাগ বিনিয়োগ করে।

এর বিপরীতে, গত ২২ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির প্রধান জোসেফ বোরেল ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের সহযোগিতার ওপর জোর দেন।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বহুত্ববাদের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে ভিন্নতা রয়েছে উল্লেখ করে বোরেল আরও বলেন, ‘চীন আরও ইতিবাচক হচ্ছে এবং আরও জোরালো প্রতিযোগিতার উপায় বের করছে।’ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। তা হলো, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, এ কথা সত্য, কিন্তু চীনের প্রতি কিছু কিছু অবস্থানের ক্ষেত্রে অথবা পদক্ষেপের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আমাদের ভিন্নতা রয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে যাতে করে চীনের প্রতি ওয়াশিংটনের নেওয়া কঠোর অবস্থান ইইউও বজায় রেখে চলে। কিন্তু ইউরোপ সে পথে হাঁটছে না। চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নতুন যে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে নেদারল্যান্ডস উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ওয়াশিংটনে বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে কথা তুলেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সাম্প্রতিক চীন সফর এ ইস্যুতে সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তিনি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার চেয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপরেই অনেক বেশি জোর দেন।

ইউরোপের ঐক্যে ফাটল

আটলান্টিক মহাসাগরের দুই তীরের মধ্যে যে বিভক্তি থাকবে, সেটা সাধারণভাবেই ধারণা করা যায়। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেই চীনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, তা নিয়ে এত স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে যে সেটা ঢাকা দেওয়া কঠিন। দৃষ্টান্ত হিসেবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সম্পাদিত ইইউ-চায়না সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে এত শোরগোল ও সমালোচনা শুরু হয়েছিল যে সেটি অনুসমর্থনের প্রয়োজন পড়েছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সদস্যরাষ্ট্রের একটি লিথুয়ানিয়া। দেশটির সরকার তাইওয়ানকে তাদের দেশে একটি বাণিজ্য কার্যালয় খোলার অনুমোদন দেয়। রাজধানী তাইপের বদলে তাইওয়ানের নাম তারা উল্লেখ করে। চীনের সঙ্গে টানাপোড়েনের প্রধান একটি ইস্যু হয়ে ওঠে এ ঘটনা। চীন এটিকে এক চীন নীতি থেকে সরে আসার বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে।

এ ঘটনা ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও মুশকিলে ফেলে। সদস্যরাষ্ট্র লিথুয়ানিয়ার পক্ষে দাঁড়াবে, নাকি দীর্ঘদিন ধরে তারা যে এক চীন নীতি বজায় রেখে চলছে, সেই অবস্থানে দাঁড়াবে, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

ওলাফ শলৎজের বেইজিং সফরও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন নেতা উদ্বেগ জানান, চীনের সঙ্গে জার্মানি আলাদা চুক্তি করলে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যকে উপেক্ষা করা হবে। উপরন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য প্রদর্শন করার জন্য ফ্রান্সের পক্ষ থেকে মাখোঁ ও শলৎজের যৌথ বেইজিং সফরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রস্তাব আপাতভাবে শলৎজ প্রত্যাখ্যান করেন।

দেশের ভেতরেই বিভক্তি

চীনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, সে বিষয়ে প্রায়ই পশ্চিমা কোনো একটি দেশের ভেতরেই ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা যায়। যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দেওয়া যাক। লন্ডনের লর্ড মেয়র’স বানকোয়েট-এ বক্তৃতাকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক চীনের প্রতি একটি ‘বলিষ্ঠ বাস্তববাদী’ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে কথা বলেন। কনজারভেটিভ পার্টির কট্টরপন্থীদের চীনের প্রতি যে অনড় অবস্থান, তা থেকে কিছুটা ভারসাম্যমূলক অবস্থান ঋষির বক্তব্যে উঠে আসে।

কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকার চীনের ক্যামেরা ও নজরদারি ব্যবস্থা ব্যবহারের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে কট্টরপন্থীদের অবস্থান যে জয়ী হয়েছে, সেই ইঙ্গিত মিলছে।

আরও পড়ুন

জার্মানির ক্ষেত্রেও একই ধরনের বিতর্ক চলছে। চীনের সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি করা নতুন একটি বিধির কারণে জার্মান সরকার বিতর্কের মুখে পড়েছে। চীনের বাইরে অন্য কোনো দেশে বাজার খুঁজতে কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেবে জার্মান সরকার। এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি মার্সিডিজ বেঞ্জের প্রধান নির্বাহী ওলা কায়েলিনিউইয়াস বলেছেন, চীনের বাজার থেকে বের হয়ে আসা চূড়ান্তভাবে অকল্পনীয় ব্যাপার। গাড়ি নির্মাণকারী ভক্সওয়াগন, বিএমডব্লিউ এবং রাসায়নিক ব্যবসার বিশাল প্রতিষ্ঠানও একই অবস্থান ব্যক্ত করেছে। মার্সিডিজ বেঞ্জসহ এই চারটি প্রতিষ্ঠান ইউরোপ থেকে চীনে যে বিনিয়োগ হয়, তার তিন ভাগের এক ভাগ বিনিয়োগ করে।

চীন ইস্যুতে জার্মানির জোট সরকারের শরিকদের মধ্যেও বিরোধ রয়েছে। গ্রিন পার্টির চীনের ব্যাপারে অনীহা রয়েছে।

এ সব প্রেক্ষাপটে মিশেলের সফর বেইজিংয়ের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। তবে বড় দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে বাণিজ্য বিষয়ে সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন যখন অস্থির, সে সময় নতুন কোনো অভিঘাত তৈরি করা চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কারও জন্যই ঠিক হবে না।

  • স্টেফেন উলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে