বিএনপির আছে আন্দোলন, আছে দাবি, কিন্তু কর্মসূচি?

রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
ছবি: সাজিদ

১.

কোনো নাগরিক যদি মনে করেন অতীতে তার সঙ্গে যে রাজনৈতিক শক্তি প্রতারণা করেছে, সে রাজনৈতিক শক্তিকে তিনি পছন্দ করবেন না— সেই অধিকার তাঁর আছে। নাগরিকের এই অধিকার নিশ্চিত করতে সক্ষম সমাজ গঠনে শক্তিহীন মানুষের আত্মসচেতনতা জরুরি। স্বৈরাচার এরশাদের সামরিক বুটের তলা থেকে উঠে দাঁড়াতে একদিন সেই শক্তিহীন মানুষের আত্মসচেতনতার উত্থান ঘটেছিল। যৌথ কর্মসূচি হিসেবে হাজির করা হয়েছিল তিন জোটের রূপরেখা।

আজকে গণতান্ত্রিকদের আমলে সেই আগের অবস্থা কতটা বদলেছে তা বড় প্রশ্ন। স্বৈরাচারি সরকারের আমল অস্ত গেছে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক আবহ বদলায়নি। তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়নি।

আরও পড়ুন

২.

বিএনপি যে ১০ দফা পেশ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে: বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ; ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ-এর আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন; বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন; অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল; খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দলীয় সব নেতা–কর্মী, সাংবাদিক ও আলেমদের সাজা বাতিল; সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দীদের অনতিবিলম্বে মুক্তিদান; দেশে সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা।

আরও পড়ুন

সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা। স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার না করা; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী আইন বাতিল করা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা; ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত, শেয়ার বাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন।

দুর্নীতি চিহ্নিত করে অতিদ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ; গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর ও সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিই যদি করেে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার কেমন করে করবে? কিংবা বর্তমান সংবিধান মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেমনে সম্ভব? কিংবা সংসদ তো সংবিধান মেনে সংশোধন করবে, চলতি সংবিধানের বাইরে গিয়ে যদি সংশোধনী হয়, যা হাইকোর্ট পরে বাতিল করে দিতে পারবে।

পুরো পাকিস্তান আমলজুড়ে সংকটের সমাধান হিসেবে জনগণ যা চেয়েছিল, তাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমান আন্দোলন নিয়ে ডয়েচে ভেলেতে এই রকম আকাঙ্ক্ষার কথাই বলেছিলেন। যা হয়েছে তারই শুধু বিচার, এইটুকু কাম্য নয়।

’৬৬ সালের ছয় দফায় তো সরাসরি ভবিষ্যতের কর্মসূচি ছিল। প্রথম দফাটি ছিল, শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি, দ্বিতীয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা। বাকি চারটি হচ্ছে, মুদ্রা বা অর্থ–সম্বন্ধীয় ক্ষমতা, রাজস্ব, কর ও শুল্ক–সম্বন্ধীয় ক্ষমতা, বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমতা ও আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা। কিন্তু ’৬৯–এর গণ-অভ্যুত্থানের ১১ দফা কর্মসূচির ৫টিই ছিল অর্থনৈতিক দফা। কিন্তু বিএনপির ১০ দফা দাবিকে পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে পার্থক্য হবে উনিশ-বিশ। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য ছয় দফার মতো রাষ্ট্র রূপান্তর কর্মসূচি কই?

পুরো পাকিস্তান আমলজুড়ে সংকটের সমাধান হিসেবে জনগণ যা চেয়েছিল, তাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমান আন্দোলন নিয়ে ডয়েচে ভেলেতে এই রকম আকাঙ্ক্ষার কথাই বলেছিলেন। যা হয়েছে তারই শুধু বিচার, এইটুকু কাম্য নয়। ভবিষ্যতেও কেউ যেন আইয়ুব খান না হয়ে উঠতে পারে, বারবার বুটের তলায় যেতে না হয়—এমন সংস্কার কর্মসূচির কথা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও কয়েক দিন আগে বলেছিলেন। তারপর আছে সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে আইনি বাধ্যবাধকতার মামলা, ’৯১–এর মতো না ঘটে। নইলে বিএনপির লড়াই জাতির লড়াই হয়ে উঠবে কেমনে?

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক
[email protected]