অভ্যুত্থানের নৈতিক ভিত্তি প্রশ্নের মুখে ফেলছে কারা 

একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের আফটার শক বা পরাঘাত থাকে। এই পরাঘাতগুলো মূল ভূমিকম্পের কারণে আশপাশে যে বিচ্যুতি তৈরি হয়, সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে। বিজ্ঞানের সূত্র বলে, ভূমিকম্পের পর প্রথম দিন পরাঘাতের যে হার, পরের দিন তা অর্ধেকে নেমে আসে। এই হারে পরাঘাত কমতে থাকে। 

একটি রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানও ভূমিকম্পের মতোই অনেক পরাঘাতের জন্ম দেয়। এগুলো গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে ভূমিকা রাখে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বছর পার হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে এত দিনে পরাঘাতের হার কমতে কমতে মিলিয়ে যাওয়ার কথা।

কিন্তু দেশের রাজনীতিতে যা ঘটছে, তাতে তেমন মনে হচ্ছে না। বোঝা যায়, অস্বাভাবিকভাবে হলেও কোনো কোনো পক্ষ বা রাজনৈতিক শক্তি পরাঘাত অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা মনে হয় এটা বুঝতে পারছে না যে গণ-অভ্যুত্থান ও তার পরের পরিস্থিতিতে যা বৈধ ও গ্রহণযোগ্য ছিল, এক বছর পর এখন আর তা নয়। 

বলা হয়, প্রেম ও যুদ্ধ বা বিপ্লবে সবই ন্যায্য। কিন্তু এরপরও কোথায় বা কখন থামতে হয়, তার একটা সীমা থাকে। জার্মান-আমেরিকান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হার্বার্ট মার্কুয়েস মনে করেন, যেকোনো সহিংস বিপ্লব ন্যায্য হতে পারে, কিন্তু যদি তা দ্রুত শেষ না হয়, তবে বিপ্লব তার নৈতিক ভিত্তি হারাতে পারে।

বাংলাদেশে ৫ আগস্ট কোনো বিপ্লব হয়নি, সহিংস পথে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দমনের চেষ্টা করেছিল উল্টো হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার। এর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যেকোনো প্রতিরোধই ছিল ন্যায্য। সেটাই গড়ে তুলেছিল ছাত্র-জনতা। গণ-অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে জরুরি কাজটি ছিল দ্রুত সব ধরনের সহিংসতা, সংঘাত ও বিরোধের অবসান ঘটানো। কিন্তু তা হয়নি, বরং এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে কোনো কোনো পক্ষ ইচ্ছা করেই তা জিইয়ে রাখতে চাইছে।

এসব কারণে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের নৈতিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের পতিত ও পরাজিত শক্তি এবং তাদের সমর্থকেরা এরই মধ্যে সেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হাসিনার মতো দীর্ঘ সময় ধরে গেড়ে বসা এক স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। একই সঙ্গে তা রাষ্ট্রকাঠামোর গভীরে ঢুকে পড়া স্বৈরাচারের শিকড় ধরেও টান দিয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থানকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে এগুলো উপড়ে ফেলা জরুরি ছিল। রাষ্ট্রকাঠামোয় বিস্তৃত স্বৈরাচারী সরকারে শিকড়-বাকড় ওপড়ানোর কাজটি তাই গণ-অভ্যুত্থানেরই অংশ। এগুলোই ছিল গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী একধরনের আফটার শক বা পরাঘাত। এগুলো ঘটেছে ছাত্র-জনতার শক্তিতে। 

অন্যদিকে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামোর সুযোগে কিছু উগ্র, হঠকারী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও নিজেদের আদর্শিক শক্তি দেখাতে মাঠে নেমে পড়ে। এই কাজে ‘মব’ হয়ে ওঠে তাদের প্রধান হাতিয়ার।

মব তৈরি করে তারা মাজার, পীর-ফকিরদের আস্তানা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলা এবং সংস্কৃতি-স্থাপনা ও শিল্পকর্ম গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করে। সংবাদমাধ্যমও এসব মব হামলার শিকার হয়েছে। এই ঘটনাগুলোও ছিল গণ-অভ্যুত্থানের পর আরেক ধরনের পরাঘাত।

গত এক বছরে সরকারের পারফরম্যান্স বা যোগ্যতা-দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু বিভিন্ন দলের এই আংশিক আধিপত্য যে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেখা যাচ্ছে, স্রেফ নিজেদের শক্তি দেখানো বা আধিপত্য ধরে রাখতেই রাজনৈতিক শক্তিগুলো মব সৃষ্টি করে সহিংসতা করছে। গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তির তরফেই এসব ঘটছে, তাই অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে  মব-নির্ভর এই পরাঘাতও অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে কিছু রাজনৈতিক শক্তি তাদের যৌক্তিক বা অযৌক্তিক যেকোনো দাবি আদায়ের জন্য এখন পুরোপুরি মব-নির্ভর হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বা সেখানে দেওয়া বক্তব্যকেও ‘মব’ কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ আছে। 

’২৪–এর গণ-অভ্যুত্থান বিভিন্ন মত, পথ ও আদর্শের রাজনৈতিক দল, শক্তি ও মানুষকে হাসিনা উৎখাতের লক্ষ্যে এক করেছিল। অভ্যুত্থান শেষে কোনো রাজনৈতিক দলই পরিস্থিতির ওপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে ঠিকই কিন্তু ক্ষমতাকাঠামোয় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকেই গেছে। দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো এক বছর ধরে রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে যেভাবে পেরেছে, নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। তা সরকারে, প্রশাসনে, শিক্ষাঙ্গনে বা রাজনীতির মাঠে যেখানেই হোক না কেন। এই কাজে তারা সফলও হয়েছে। কিন্তু এই আধিপত্য আংশিক, কোনো পক্ষেরই একক নিয়ন্ত্রণ নয়। এই অবস্থাটি বেশ বিপজ্জনক। 

আরও পড়ুন

গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্ট্যাথিস ক্যালাভাস তাঁর দ্য লজিক অব ভায়োলেন্স ইন সিভিল ওয়ার বইয়ে এমন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, যেখানে কোনো পক্ষ আংশিক আধিপত্য বিস্তার করে কিন্তু পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায় না, সেখানে টার্গেটেড ভায়োলেন্স বা নিশানানির্ভর সহিংসতার পরিস্থিতি তৈরি হয়। নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের প্রমাণ, আধিপত্য ধরে রাখা বা বিস্তারের জন্য সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটে বা ঘটানো হয়।

সাম্প্রতিক নানা সহিংস ঘটনা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ সম্ভবত এখন এমনই একটি সময় পার করছে। এখানে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজদের আংশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তা ধরে রাখা ও বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

গত এক বছরে সরকারের পারফরম্যান্স বা যোগ্যতা-দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু বিভিন্ন দলের এই আংশিক আধিপত্য যে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেখা যাচ্ছে, স্রেফ নিজেদের শক্তি দেখানো বা আধিপত্য ধরে রাখতেই রাজনৈতিক শক্তিগুলো মব সৃষ্টি করে সহিংসতা করছে। গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তির তরফেই এসব ঘটছে, তাই অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শক্তির আংশিক আধিপত্যনির্ভর এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন সহিংসতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও এসব শক্তির প্রভাব ও বিভক্তি ঠিকভাবে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান ও এর পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর অস্বস্তিকর সম্পর্কের বিষয়টি এখন নানা মহলে আলোচিত। এসব আলোচনা দেশের রাজনীতি ও জনমনে প্রভাব ফেলছে। 

আরও পড়ুন

তা ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের যত আশা জেগেছিল, সেটাও বেশ ফিকে হয়ে এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ বেড়েছে। যেগুলোতে তারা একমত হয়েছে, এর বাইরে খুব বেশি সংস্কার সুযোগ বা সময় কোনোটাই নেই। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই একটি বাস্তব চাহিদায় পরিণত হয়েছে। সরকার নিশ্চিতভাবেই তা বুঝতে পেরেছে এবং শুরুতে যে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, তার আগেই নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে। 

কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও নেতাদের কথাবার্তায় নির্বাচনবিরোধী সুর পাওয়া যাচ্ছে। খুব বেশি সংস্কারের যখন আর সুযোগ নেই এবং রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর নানামুখী চাপে সরকারও ব্যতিব্যস্ত, তখন সংস্কারের দাবিতে অটল থাকার অর্থ স্পষ্টতই নির্বাচনের বিরোধিতা করা। এটা রাজনীতিকে একটা অনিশ্চয়তা ও অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনীতিতে অচলাবস্থা মানে সহিংসতা টিকিয়ে রাখার ঝুঁকি তৈরি করা। কোনো কোনো পক্ষ সম্ভবত এমনটাই চাইছে। এমন একটি পরিস্থিতি গণ-অভ্যুত্থানের পরাজিত শক্তিকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। 

স্লোভাক দার্শনিক স্লাভো জিজেকের একটি কথা আছে, ‘সামটাইমস ডুইং নাথিং ইজ মোস্ট ভায়োলেন্স থিং টু ডু’ মানে কখনো কিছু না করাই সবচেয়ে বড় সহিংস কাজ। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী সক্রিয় আক্রমণ ছাড়াও সহিংসতা সম্ভব। এখন নির্বাচন করতে না চাওয়া, সমঝোতার পথ না ধরা বা নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে অচলাবস্থা তৈরি করাকেও সেই অর্থে একধরনের ‘সহিংসতা’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। দেখা যাচ্ছে সক্রিয় আক্রমণের সহিংসতা এবং কিছু না করার সহিংসতা—বাংলাদেশ এখন দুই ধরনের সহিংসতার কবলে পড়েছে।

গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে এই দ্বিমুখী সহিংসতা অব্যাহত থাকলে দেশের সংকট গভীর থেকে গভীরতর হবে। গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমান অচলাবস্থা কাটাতে, গণ-অভ্যুত্থানের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে না চাইলে এবং পরাজিত শক্তির ফিরে আসার পথ বন্ধ করতে হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্ধারিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই।  

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]

* মতামত লেখকের নিজস্ব