কলেজছাত্র আলভী ও সানি যখন রাষ্ট্রের চোখে ভয়ংকর অপরাধী!

আলভী মাহমুদ ও বখতিয়ার উদ্দিন সানি নামের দুই কলেজশিক্ষার্থীকে থানা থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা টেলিফোন করে বললেন, ‘কাল আপনাদের কর্মসূচি। সামনে বইমেলা। আপনাদের সঙ্গে কথা আছে। একবার থানায় আসুন।’

বারবার থানা থেকে ফোন করা হলে তাঁরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। যাওয়ামাত্র এক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁদের চড়থাপ্পড় দিয়ে গরাদে ঢুকিয়ে দেন। এরপর বিষয়টি জানাজানি হলে তাঁরা যে ছাত্রসংগঠনের কর্মী, সেই সংগঠনের সভাপতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে টেলিফোন করে জানতে চান, কেন দুই ছাত্রকে থানার গরাদে নিয়ে যাওয়া হলো?

জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা আবার বললেন, কর্মসূচি নিয়ে কথাবার্তা বলতে তাঁদের ডাকা হয়েছে। এরপর ওই দুই ছাত্রকে গরাদ থেকে বের করে ডিউটি অফিসারের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে একটি পুরোনো মামলায় তাঁদের আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। থানায় তাদের সঙ্গে স্বজন ও সহযোদ্ধাদের কথা বলারও সুযোগ দেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন

এ ঘটনা ঘটেছে শাহবাগ থানায়। আর ওই শিক্ষার্থী দুজন হলেন ঢাকার নটর ডেম কলেজের আলভী মাহমুদ ও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মোহাম্মদ সানি। তাঁদের অপরাধ, অন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড টাইম বা দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগের দাবিতে গত ২৩ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার উদ্দেশ্য জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ আহ্বান করেছিলেন। পুলিশ বাধা দিলে তাঁরা রাস্তায় অবস্থান নেন। এরপর পুলিশ লাঠিপেটা করে করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে শাহবাগ থানার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হামলার অভিযোগ আনেন।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ন্যায্য কি অন্যায্য, সেই বিতর্কে যেতে চাই না। সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি বিপক্ষেও যুক্তি আছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক পুলিশ নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ারই কর্মসূচি নিয়েছিলেন। কিন্তু এই নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক বিষয়টিকেও থানা-পুলিশ রাজনৈতিক রং লাগিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। এর কারণ, শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ এনেছেন।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ারই কর্মসূচি নিয়েছিলেন। কিন্তু এই নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক বিষয়টিকেও থানা-পুলিশ রাজনৈতিক রং লাগিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। এর কারণ, শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ এনেছেন। পুলিশের যে কর্মকর্তারা হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, আলভী ও সানি তাঁদের নামও বলেছেন। এটাই সম্ভবত তাঁদের ওপর পুলিশের রোষের কারণ।পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের মৌখিক অভিযোগের জবাব দিয়েছেন চড়থাপ্পড় দিয়ে। থানার গরাদে আটকে রেখে এবং সব শেষে কারাগারে পাঠিয়ে। ২৩ জানুয়ারি প্রেসক্লাবের সামনের ঘটনায় পুলিশ কোনো মামলা করেননি। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি, আলভী ও সানি ওই দিন আইনশৃঙ্খলাপরিপন্থী কোনো কাজ করেননি। তারপরও পুলিশ তাঁদের আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড দাবি করল!

এখন দেখার বিষয় সেই পুরোনো মামলাটি কী? গত বছরের ৭ অক্টোবর বিকেলে ‘আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ’-এর ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মরণসভার আয়োজন করে ছাত্র অধিকার পরিষদ। সেখানে ছাত্রলীগ হামলা করে তাঁদের ধাওয়া দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। হামলায় পরিষদের অন্তত ১৫ নেতা-কর্মী আহত হন।

পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানে গিয়েও তাঁদের পেটায় ছাত্রলীগ। বিকেলে হাসপাতাল থেকে পরিষদের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটক করে শাহবাগ থানার পুলিশ। সেই রাতে ছাত্রলীগের দুই নেতা বাদী হয়ে ছাত্র অধিকারের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা করেন। সেই মামলায় কি আলভী ও সানির নাম ছিল? যদি না থেকে থাকে তবে কোন যুক্তিতে তাদের ফাঁসানো হলো? ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাস ও হাসপাতালে যাঁদের হামলার শিকার হলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো হামলা হয়নি। কেননা হামলা করেছিল সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ। আইনের রক্ষক পুলিশ যথাযথ কর্তব্যবোধের পরিচয় দিল বটে!

আরও পড়ুন

ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মসূচির সঙ্গে ২৩ জানুয়ারির কর্মসূচি কিংবা আলভী ও সানির কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও তাঁদের সেই মামলায় আসামি করে পুলিশ রিমান্ড দাবি করেছে। আদালত ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। এই পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে পুলিশ কী তদন্ত করবে ও প্রতিবেদন দেবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। এই মামলায় আলভী ও সানির সংযুক্ততা প্রমাণ করতে না পারলে পুলিশ নতুন কোনো মামলা দিয়ে তাদের আরও হয়রানি করবে না তা নিশ্চিত করে বলে যাচ্ছে না। কিন্তু দুই শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা কি সেই পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাবনায় একবারও এল না! মানবিক কোনো বিবেচনা বোধও কাজ করল না!

বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় দফা ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ চাইতে গিয়ে তাঁরা এখন কারাগারে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের পক্ষ থেকে আলভী ও সানির মুক্তির দাবি করা হয়েছে। তাদের মুক্তির দাবিতে শাহবাগ এলাকা ও ক্যাম্পাসে একাধিক সমাবেশ হয়েছে। এ রকম একটি সমাবেশে সানির বড় ভাই মাহফুজ আনাস সাব্বির বলেন, ‘আজকে আমার ছোট ভাই সামি শুধু সেকেন্ড টাইমের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়েছে বলে পুলিশ তাকে আটক করে রেখেছে। আমার অসুস্থ মা-বাবার কী রকম অনুভূতি হচ্ছে, আপনারা কি ভাবতে পারেন? যারা আমার ছোট ভাইকে এভাবে জেলে আটকে রেখেছে, আজ যদি তাদের সন্তানকে এ রকম অন্যায়ভাবে আটক করা হতো, তাহলে তাদের অনুভূতি কেমন হতো?’

এ প্রশ্ন আমাদেরও। এর আগে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়েও অনেক শিক্ষার্থী শাহবাগ থানা-পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন।

আলভী ও সানি কি দুর্ধর্ষ অপরাধী যে মনগড়া কোনো মামলায় তাঁদের আসামি করে কারাগারে পাঠিয়ে রিমান্ড চাইতে হবে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি