মেডিকেল শিক্ষাকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে আলাদা করার যুক্তি কী?

মেডিকেল শিক্ষাকে হাসপাতাল থেকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। হাসপাতাল ছাড়া মেডিকেল শিক্ষা অর্থহীন
ফাইল ছবি

দেশে অধিদপ্তর ও মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা ১৯৭৫ সাল থেকে আলাদাভাবে পরিচালিত হচ্ছে। মাঝে ১৯৯৮ সালে মাঠপর্যায়ে (অর্থাৎ জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে) স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা একীভূত করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে একটি অযাচিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা রোহিত করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। পরবর্তী সময় ১৯৭৭ সালে নার্সিং অধিদপ্তর গঠন করা হয়। বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য খাতের দেহকে এভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করা হলেও ২০১৭ সালের ১৬ মার্চের আগপর্যন্ত পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি মাথা ছিল। অর্থাৎ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার কল্যাণ সেবাসহ সব সেবার নেতৃত্বে ছিলেন একজন নেতা অর্থাৎ একজন সচিব।

২০১৭ সালের ১৬ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুটি মাথায় রূপান্তরিত করা হয়। একটি হলো মেডিকেল শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ এবং অন্যটি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। বানানো হয় দুজন নেতা অর্থাৎ দুজন সচিব। মেডিকেল শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অধীন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউটসহ মেডিকেল শিক্ষার সব প্রতিষ্ঠানকে আনা হয়। পাশাপাশি পরিবার–পরিকল্পনা ও মাতৃ এবং শিশু স্বাস্থ্যসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশও এই বিভাগের অধীন আনা হয়।

অন্যদিকে, প্রাথমিক থেকে টারশিয়ারি পর্যন্ত এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে। মাথা আলাদা করার পর দেহকে আবারও বিখণ্ডিত করার প্রয়োজন হয়। ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আলাদা হয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের দেহকে আবার বিভাজিত করা হয়। অর্থাৎ মেডিকেল শিক্ষা তথা মেডিকেল কলেজের পাঠদান ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা’ বিভাগের অধীন ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এক্সপেরিমেন্ট ক্ষেত্র তথা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ‘স্বাস্থ্যসেবা’ বিভাগের অধীন আনা হয়। এসব অপারেশন যে কোনো দক্ষ সার্জনের দ্বারা হয়নি, তা একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন। বিভাজিত বিভাগের ও অধিদপ্তরের নাম ‘মেডিকেল শিক্ষার’ পরিবর্তে ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা’ শব্দ ব্যবহার করা এ হাতুড়ে সার্জারি অর্থাৎ অপারেশনের আরেকটি উদাহরণ।

এত বড় ও জটিল অপারেশন চাকরিরত বা অবসরপ্রাপ্ত কোনো আমলা সার্জন দিয়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন বিজ্ঞ, দক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক সার্জন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই সেই যোগ্য সার্জন। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে পুনঃ সার্জারির মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে বাঁচান।

প্রকৃতপক্ষে, মেডিকেল শিক্ষাকে হাসপাতাল থেকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। হাসপাতাল ছাড়া মেডিকেল শিক্ষা অর্থহীন। ইন্টার্নশিপসহ সব এক্সপেরিমেন্টের জন্য মেডিকেল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের হাসপাতালের সঙ্গেই সংযুক্ত থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা এক মাথার সঙ্গে এবং মেডিকেল কলেজ প্রশাসন আরেক মাথার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়বে ও মেডিকেল শিক্ষার মান কমবে, যা জাতির জন্য শুভকর হবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো শুধু মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এক্সপেরিমেন্ট ক্ষেত্র নয়।

এগুলো সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি চিকিৎসাসেবারও প্রধান কেন্দ্র। বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিজস্ব ডাক্তার বলতে মুষ্টিমেয় আবাসিক চিকিৎসক ও আবাসিক সার্জনকে বোঝায়, যাঁরা মূলত মেডিকেল অফিসার পদ মর্যাদার। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মূলত পরিচালিত হয় মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল বিষয়ের শিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের মাধ্যমে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দ্বি-মাথাবিশিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গুণগত চিকিৎসার ক্ষেত্রেও মানানসই নয়। তাই মেডিকেল শিক্ষাকে স্বাস্থ্যসেবা থেকে আলাদা করার যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আজ এই বিভাজনের অর্ধযুগ অর্থাৎ ছয় বছর পূর্তি হলো। তাই এই বিভাজন থেকে জাতি কী পেল, তা পেছনে ফিরে দেখা দরকার। এই বিভাজনের কলাকৌশলীদের তাত্ত্বিক যুক্তি হয়তো ছিল দুটি দেহ, দুটি মাথা হলে মনিটরিং ও সুপারভিশন শক্তিশালী হবে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি বৃদ্ধি পাবে। সেটা হয়তো হতো, যদি দুই বিভাগের মধ্যে কার্যকরভাবে সমন্বয় করা যেত। কিন্তু যে দেশের সরকারি কর্মকর্তারা সারাক্ষণ ব্যস্ত শুধু ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার খোঁজে এবং কর্মশালার নামে খাম টোকানোর পেছনে, সেখানে এই ধরনের বিভাজন যে শুধু দুই বিভাগের মধ্যে রেষারেষি বৃদ্ধি করবে, তা হয়তো তাদের জানা ছিল না।

কার্যত গত ছয় বছরে দুই বিভাগের মধ্যে রেষারেষি চরমে পৌঁছেছে এবং সমন্বয়হীনতায় কাজের গতি অনেকটা ধীর হয়েছে। হাতুড়ে কলাকৌশলীদের দ্বারা এই অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত সার্জারির মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুই টুকরা করার ফলে স্বাস্থ্য খাতে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে অবিরাম রক্ত ঝরছে, যা বন্ধে বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি পুনঃ সার্জারির আশু প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় অপারেশন করতে হবে, সেটা কীভাবে করতে হবে এবং কে করবে, তা নিশ্চয় আলোচনার দাবি রাখে।

আরও পড়ুন

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হলো একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল অংশ, যা কার্যকরভাবে পরিচালিত করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্জন নিশ্চিত হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অনেকটা দুর্বল। গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকলেও উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। তা ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দ্বিখণ্ডিতভাবে বাস্তবায়িত হওয়ায় একদিকে যেমন সম্পদের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে মানুষ কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর শহরাঞ্চলে সরকারিভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কোনো কাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। তাই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে প্রতিরোধ ও প্রমোশনাল স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিয়ে গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানো এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নাধীন আলো ক্লিনিক কার্যক্রম বড় পরিসরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ গড়ে তোলা জরুরি।

আরও পড়ুন

আর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আকার অনেক বড় হওয়ার কারণে তা পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তৃতীয় মাথা বা আরেকটা অধিদপ্তর গঠন না করে বর্তমানে বিভক্ত দুই মাথাযুক্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পুনঃ সার্জারির মাধ্যমে একটিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পরিণত করা। যার অধীন থাকবে গ্রাম ও শহরের সব মানুষের জন্য পরিবার কল্যাণ এবং পুষ্টিসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার কল্যাণ সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত করে উপজেলা বা থানা পর্যায়ের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। অন্যটিকে মেডিকেল শিক্ষা এবং সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেবা বিভাগে পরিণত করা।

এ ক্ষেত্রে মেডিকেল ক্যাডারকেও দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য ক্যাডার ও অন্যটি সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি স্বাস্থ্য ক্যাডার। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একীভূত করতে হবে যেন বর্তমানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যেসব জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা আছে, তা নিরসন করা যায়। উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরভিত্তিক দুই স্তরবিশিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো পারস্পরিক বৈষম্য ও দীর্ঘসূত্রতা বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে মেডিকেল প্রফেশনালদের পদায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

এত বড় ও জটিল অপারেশন চাকরিরত বা অবসরপ্রাপ্ত কোনো আমলা সার্জন দিয়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন বিজ্ঞ, দক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক সার্জন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই সেই যোগ্য সার্জন। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে পুনঃ সার্জারির মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে বাঁচান।

  • ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ অধ্যাপক স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যলিয়।