‘আই লাভ ইউ’ আছে, মানুষ দুটো নেই

টুইটারের এই ছবির পরিচিতি বলছে, এটা সিরিয়ার আলেপ্পোর ছবি। ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের ছবি। ছবিটা একটা নববিবাহিত দম্পতির ঘরের।
ছবি : টুইটার

এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি। টুইটারের এই ছবির পরিচিতি বলছে, এটা সিরিয়ার আলেপ্পোর ছবি। ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের ছবি। ছবিটা একটা নববিবাহিত দম্পতির ঘরের। ঘরের একটা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। ছাদ গেছে বিধ্বস্ত হয়ে। কিন্তু দেয়ালে সাজানো আছে রঙিন অক্ষরগুলো। আই লাভ ইউ। ইউয়ের ও অক্ষরটাও পড়ে গেছে। আর নেই বর আর বধূ।

১৪ ফেব্রুয়ারি এই ছবিটা আমাকে পাঠিয়েছেন কবি ও লেখক রাফসান গালিব। আমাদের সহকর্মী। ওই দিন ছিল বাংলাদেশের পয়লা ফাল্গুন। আর ভালোবাসা দিবস।

বর নেই। বধূ নেই। ভালোবাসা আছে। মানব নেই, মানবী নেই, প্রেম রয়ে গেছে। আছে কী? সিরিয়ার কথা কি পৃথিবীর মানুষ মনে রেখেছে? তুরস্কের কথা কি পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষ ভাবছে বসে! একান্তে, একটুখানি, গভীর ভালোবাসা আর মমতা নিয়ে?

ভালোবাসা তো আছেই। মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা। সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা। বাবার ভালোবাসা! দয়িতার জন্য যুবকের ভালোবাসা।

সিরিয়া আর তুরস্কের এই ভূমিকম্পে এখনো পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ! তুরস্কে এখন খোঁজ করা হচ্ছে বাড়িগুলো কারা বানিয়েছে এত ভঙ্গুর করে! সে তো একটা প্রশ্ন বটেই। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, সিরিয়া যুদ্ধে ১০ বছরে মারা গেছে ৩ লক্ষাধিক মানুষ। এটা জাতিসংঘের হিসাব। একটা এনজিওর হিসাবে ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ মারা গেছে এই যুদ্ধে।

প্রকৃতির কী বিচিত্র খেয়াল। আল্লাহর কী কুদরত! সিরিয়ার জেন্দেরিস শহরে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। সেখানেই জন্ম নেয় তাঁর সন্তান। মা মারা যান। শিশুটির নাড়ি পেঁচিয়ে যায়। উদ্ধারকর্মীরা শিশুটিকে উদ্ধার করে জীবিত। শিশুটি বাবাসহ পাঁচজন স্বজনকে হারিয়ে একা এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কন্যাশিশুটির নাম রাখা হয়েছে আয়া। আয়া মানে অলৌকিক। আয়াকে দত্তক নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন হাজার হাজার দম্পতি। ভালোবাসা নেই, ভালোবাসা আছে!

তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশ। ১৮ মাসের মাশাল ঘুমোচ্ছে। পাশে ঘুমোচ্ছেন তার বাবা আর মা। ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ল ঘর। বাবা কোনোরকমে বের হতে পারলেন। মা আর শিশু মাশাল আটকে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। ৫৫ ঘণ্টা পর মাশালকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার মা তাকে বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এই খবর যখন প্রকাশ করা হয়, তখনো মাকে উদ্ধার করা যায়নি।

ভালোবাসা নেই। ভালোবাসা আছে। মায়ের বুক থেকে ভালোবাসার সঞ্জীবনী সুধা পায় শিশুরা। আমরা সবাই মাতৃস্নেহের সুধা পেয়েই পুষ্ট হয়েছি। বেঁচে আছি।

ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানুষ কত অসহায়! ‘কত দূর এগোল মানুষ!’ মানুষ এই পৃথিবীটাকে ছয়বার ধ্বংস করার মতো মারণাস্ত্র জমা করে রেখেছে পৃথিবীতে! কিন্তু মানুষকে বাঁচানোর আয়োজন কই?

সিরিয়া আর তুরস্কের এই ভূমিকম্পে এখনো পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় ৪২ হাজার মানুষ! তুরস্কে এখন খোঁজ করা হচ্ছে বাড়িগুলো কারা বানিয়েছে এত ভঙ্গুর করে! সে তো একটা প্রশ্ন বটেই। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, সিরিয়া যুদ্ধে ১০ বছরে মারা গেছে ৩ লক্ষাধিক মানুষ। এটা জাতিসংঘের হিসাব। একটা এনজিওর হিসাবে ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ মারা গেছে এই যুদ্ধে।

মানুষের প্রধান শত্রু প্রকৃতি নয়। মানুষের প্রধান শত্রু মানুষ।

কে বাঁচাবে আয়াদের? আয়া কার কোলে যাবে? ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেলেও সে কি রক্ষা পাবে বোমা থেকে? রক্ষা পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল থেকে? নিজেকে বাঁচাতে পারবে মানুষের সৃষ্টি করা মানবিক বিপর্যয় থেকে?

আরও পড়ুন

আমরা আয়াদের বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আমরা চাই ভালো থাকুক আয়া। ঘরে ঘরে সুখে থাকুক পুরুষ আর রমণী। শিশুদের কলতানে মুখর থাকুক স্কুল প্রাঙ্গণ! অভয়াশ্রম হয়ে উঠুক আমাদের পৃথিবী!

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতাটা বারবার করে পড়ি:
ও ভাই, ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে-
গোলাগুলির গোলেতে নয়, গভীর ভালোবেসে।
খড়ুগ, সায়ক, শাণিত তরবার,
কতটুকুন সাধ্য তাহার, কি বা তাহার ধার?
শত্রুকে সে জিনতে পারে, কিনতে নারে যে সে-
ও তার স্বভাব সর্বনেশে।
ভালোবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়-
সে যে সৃজন পরিচয়।
শত আঘাত-ব্যথা-অপমান লয় সে কোলে এসে,
মৃত্যুরে সে বন্ধু বলে জাপটে ধরে শেষে।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক