আলাদা শিশু অধিদপ্তরের জন্য আর কত অপেক্ষা

শিশুদের জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তরের দাবিটি পুরোনো। দীর্ঘদিন ধরে দাবিটি নানাভাবে নানা মহলে আলোচিত হয়েছে। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে বারবার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। তারপর সেই প্রতিশ্রুতিগুলো বুদ্‌বুদের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

এ দেশে আছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তরসহ অনেক অনেক অধিদপ্তর। এমনকি মাছের সুরক্ষার জন্য আছে মৎস্য অধিদপ্তর, বনের সুরক্ষার জন্য বন অধিদপ্তর, প্রাণীদের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। অথচ দেশের ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ৮ কোটি শিশুর এই দেশে শিশুদের জন্য নেই আলাদা কোনো অধিদপ্তর।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মূলত শিশুদের সাংস্কৃতিক ও মানসিক বিকাশের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। শিশু একাডেমি কাজ করে শিশুদের উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে এবং এর কাজের পরিধিও শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ সাধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় রয়েছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। কিন্তু শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য নেই আলাদা কোনো অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম শিশু অধিকার আইন প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে (সিআরসি) স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশের আইন কাঠামোতে শিশু সুরক্ষার জন্য বিদ্যমান আছে নানা আইন ও নীতিমালা, যেমন জাতীয় শিশু নীতি-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন ও দমন আইন-২০০০, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫, শ্রম আইন-২০০৬, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ সহ আরও অনেক আইন। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নারী বা শিশুদের জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও দায়বদ্ধতাকে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন কাঠামোতে শিশুদের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু এই যাত্রায় আমরা এখনো সফল হতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে রয়েছে বেশ কিছু আইনগত সীমাবদ্ধতা, রয়েছে আইন বাস্তবায়নে নানা প্রতিকূলতা, কিছু উদ্যোগের অভাব এবং কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। এর মধ্যে অন্যতম হলো শিশু আইন ২০১৩–এর খসড়া বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়া এবং শিশুদের জন্য পৃথক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিটি বাস্তবায়নের অভাব। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিশুর অধিকার লঙ্ঘনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ত্রুটিও।

বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী শিশুদের জীবন এমনিতেই বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি দিয়ে অথবা একমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুদের জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আর এখানেই শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তরের দাবিটি বারবার ঘুরে ফিরে আসে।

মনে পড়ে, ২০১৬ সালে ১০টি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার জোট চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেছিলেন, ‘শিশুদের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য একটি আলাদা অধিদপ্তর থাকা জরুরি। কারণ, শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। যুব, নারীদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর থাকলে শিশুদের জন্য কেন নয়? শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর চাওয়া কোনো অতিরিক্ত চাওয়া নয়।’ তিনি আরও আশ্বস্ত করেছিলেন, তিনি অচিরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেবেন। অথচ আজ এত বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই ন্যায্য দাবিটি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।

গত বছর আগস্টে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক তাঁর বক্তব্যে শিশুদের জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তর গঠনের জন্য দ্রুত উদ্যোগ নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করবেন বলে জানিয়েছিলেন। প্রায় একটি বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে কোনো আয়োজন দেখা যায়নি। শিশু অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও সরকারকে সুপারিশ করেছে। জানা যায় সরকার সুপারিশটি গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

বর্তমানে প্রায় ২৩টি মন্ত্রণালয় শিশু উন্নয়ন ও অধিকারের নিয়ে কাজ করছে। এই মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে নেই সমন্বিত পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও আদালতের বিভিন্ন সময়ের নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে প্রায়ই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়, একটি মন্ত্রণালয়ের অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের ওপর ব্যর্থতার দায়ভার চাপানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী শিশুদের জীবন এমনিতেই বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। তাই কোনো একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি দিয়ে অথবা একমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুদের জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আর এখানেই শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তরের দাবিটি বারবার ঘুরে ফিরে আসে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে শুধু শিশু অধিদপ্তরের অভাবে অনেক প্রচেষ্টার বিনিময়ে শিশুকেন্দ্রিক যে বাজেটগুলো কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল, তার সুষ্ঠু সমন্বয় করা যায়নি। পৃথক শিশু অধিদপ্তর থাকলে শিশুকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর সমন্বয়, বাস্তবায়ন ও তত্ত্বাবধান অনেক সহজে করা সম্ভব হবে।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকার পৃথক শিশু অধিদপ্তরের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এখন প্রয়োজন দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পৃথক শিশু অধিদপ্তর স্থাপনে রয়েছে সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতার এই যুক্তি মূলত সরকারের ইচ্ছাশক্তির সীমাবদ্ধতাকেই নির্দেশ করে। আমরা জানি, শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করলে এর সুফল কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়; অথচ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ শিশুদের জন্য পৃথক অধিদপ্তরের এই দাবি বারবার উপেক্ষিত হয়। তাই অচিরেই শিশুদের জন্য পৃথক অধিদপ্তরের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
    [email protected]