শিশুর সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তি আর কত দিন

শিশুর সংজ্ঞা নিয়ে সব বিভ্রান্তির অবসান হোক। শিশুরা তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করুক, শিশুর তাদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাক।

সম্প্রতি উদ্‌যাপিত হলো জাতীয় শিশু দিবস। প্রতিবারের মতো এ বছরও দিবসটিতে সরকারের পক্ষ থেকে শিশুদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে। সরকারপ্রধান জানিয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্য হলো শিশুরা নিরাপদে থাকবে, সুন্দর জীবন লাভ করবে। বলা হয়েছে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা।

দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি শিশুর অধিকার নিয়ে। শিশুর সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন, তা হলো শিশুর জন্য সর্বজনীন ও সর্বত্র গ্রহণযোগ্য একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। কারণ, শিশুর সংজ্ঞার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে শিশুর অধিকার, সুরক্ষা ও তার বিকাশের বিষয়গুলো। ভাবতে অবাক লাগে স্বাধীনতার একান্ন বছর পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত শিশুর জন্য সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারেনি। শিশুর বয়স নিয়ে আছে নানা বিভ্রান্তি। শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের দেশে প্রচলিত আছে নানান নীতি ও আইন। কিন্তু শিশুর বয়স নির্ধারণ নিয়ে এসব আইনে আছে সমন্বয়হীনতা। শিশুর বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসব আইন ও নীতিমালার মধ্যে সমন্বয়হীনতা শিশুর সংজ্ঞাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর প্রভাব পড়ছে শিশুর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে।

জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার কনভেনশন (সিআরসি) ঘোষণা করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর একটি। শিশু অধিকার কনভেনশনের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে, ‘আঠারো বছরের কম বয়সী সকল মানুষই শিশু।’ শিশু অধিকার কনভেনশন ঘোষণার ১৫ বছর আগেই বাংলাদেশের শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৭৪ সালে শিশু অধিকার আইন প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন রহিত করে প্রণীত হয় শিশু আইন-২০১৩। শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা-৪-এ বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রচলিত নানা আইন ও নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংস্কার না আসায় শিশুর সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণে দেখা দিচ্ছে নানান বিভ্রান্তি ও জটিলতা।

চলিত আইনগুলোর যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে শিশুর জন্য একটি সর্বজনীন বয়স নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। একটি দেশের শিশুরা পরিচিত হোক একটি সংজ্ঞা দ্বারাই। বাংলাদেশের সব আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক নাগরিককে শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হোক। শিশুর সংজ্ঞা নিয়ে সব বিভ্রান্তির অবসান হোক। শিশুরা তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করুক, শিশুর তাদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাক।

বাংলাদেশের জাতীয় শিশুনীতি-২০১১-এর ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিকে বুঝাবে।’ আর ‘কিশোর-কিশোরী বলতে ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের বুঝাবে।’ প্রথম সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সব ব্যক্তি শিশু বলে বিবেচিত হচ্ছে, কিন্তু পরের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা একই সঙ্গে ‘শিশু’ ও ‘কিশোর-কিশোরী’ হিসেবেও সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন ও দমন আইন-২০০০-এ প্রদত্ত শিশু ও নারীর সংজ্ঞাও বিভ্রান্তি তৈরি করছে। এই আইনে প্রদত্ত সংজ্ঞায় ‘নবজাতক শিশু’ অর্থ অনূর্ধ্ব ৪০ দিন বয়সের কোনো শিশু; ‘শিশু’ অর্থ অনধিক ১৬ বছর বয়সের কোনো ব্যক্তি এবং ‘নারী’ অর্থ যেকোনো বয়সের নারী। এই আইন অনুযায়ী ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে না, যা জাতীয় শিশুনীতি-২০১১ ও শিশু আইন-২০১৩-তে বর্ণিত শিশুর সংজ্ঞার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আবার স্ত্রীলিঙ্গের অধিকারী সবাইকে ‘নারী’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করায় এই সংজ্ঞা শিশুর স্বকীয় অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘শিশু’ অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেননি, এমন কোনো ব্যক্তি; ‘কিশোর’ অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেছে কিন্তু ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করেননি, এমন কোনো ব্যক্তি এবং ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ অর্থ ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করেছেন, এমন কোনো ব্যক্তি। অর্থাৎ এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা শিশু হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না, যা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ, জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ ও শিশু আইন ২০১৩-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫-তে শিশুর বয়স সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু বলা না হলেও গৃহকর্মীর বয়স অংশে গৃহকর্মী নিয়োগে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর বিধান অনুসরণ করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে আবার মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ অনুযায়ী ‘শিশু’ অর্থ ‘১৮ বছর বয়স পূর্ণ করেনি, এমন কোনো ব্যক্তি’। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭-এর ২ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, বিয়ের ক্ষেত্রে ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ অর্থ ২১ বছর পূর্ণ করেনি, এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেনি এমন কোনো নারী। বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ের সাবালকত্বের এই বৈষম্যও যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। এই আইন অনুযায়ী বিয়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক নারীর বয়স শিশু আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও পুরুষের বয়স আইনটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অন্যদিকে আবার সাবালকত্ব আইন ১৯৭৫ অনুসারে নাবালকের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে সে সাবালক বলে গণ্য হয়।

আরও পড়ুন

শিশুর বয়স নিয়ে তাই নানান আইনি ব্যাখ্যার গ্যাঁড়াকলে অনেক ক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশুর অধিকার। শিশু তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, নানা অন্যায়-অন্যায্য আচরণের শিকার হচ্ছে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শিশু আইনের আশ্রয় লাভেও ব্যর্থ হচ্ছে। এককথায় আইন শিশুকে সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষা দিতে পারছে না। একে তো আছে আইনের সঠিক প্রয়োগে গাফিলতি; তার ওপর প্রচলিত আইনগুলোও যদি শিশুর সংজ্ঞাকে বারবার বিভ্রান্ত করে, তবে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার পথ আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই প্রচলিত আইনগুলোর যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে শিশুর জন্য একটি সর্বজনীন বয়স নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। একটি দেশের শিশুরা পরিচিত হোক একটি সংজ্ঞা দ্বারাই। বাংলাদেশের সব আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক নাগরিককে শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হোক। শিশুর সংজ্ঞা নিয়ে সব বিভ্রান্তির অবসান হোক। শিশুরা তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করুক, শিশুর তাদের স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাক।

নিশাত সুলতানা উপপরিচালক, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড জাস্টিস ফর চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ। [email protected]