আমরা সবাই রাজা, চলছে কিসের রাজত্ব

বেপরোয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় দুর্ঘটনার শিকার হন এক মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী। ঢাকার বিজয় সরণীর দৃশ্য।ফাইল ছবি: সাইফুল ইসলাম।

ঈদের দিন বিকেল পৌনে পাঁচটা; স্থান সাভারের নবীনগর বাসস্ট্যান্ড। ঢাকা থেকে সে পর্যন্ত ফাঁকা রাস্তায় নির্ঝঞ্ঝাটেই যাওয়া গেছে; কিন্তু সেখানে হঠাৎ যানজট। নবীনগর মোড় পার হয়ে বাইপাইলের দিকে যাওয়াই যাচ্ছে না।

কোনোমতে মোড় পার হওয়ার পর বোঝা গেল প্রকৃত কারণ কী। ঈদের দিন সেখানে ছিল না ট্রাফিক পুলিশ। মোড়ের ওপর সব বাস যে যার মতো দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠাচ্ছে-নামাচ্ছে। সেই সঙ্গে রাজ্যের সব অটোরিকশা রাস্তায় নেমে গেছে।

এরপর বাইপাইল পর্যন্ত গাড়ি চলল অটোরিকশার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। গাড়ির গতি ৬০ কিলোমিটার ছাড়াতেই সামনে এসে পড়ে অটোরিকশা। একসময় চন্দ্রা মোড় পেরোনো গেল।

এরপর শুরু হলো বাইকারদের দাপট। চার লেনের প্রশস্ত খালি রাস্তায় হেলমেট ছাড়া কিশোর ও সদ্য তরুণ বাইকাররা ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বাইক চালাচ্ছিল।
কখনো কখনো মনে হচ্ছিল, বাইক যেন গাড়ির ওপর এসে পড়ল।

যা হোক, শেষমেশ অঘটন ছাড়াই টাঙ্গাইল পৌঁছানো গেল। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিল, এ কোন দেশ, যেখানে মানুষ সুযোগ পেলেই যার যা খুশি করতে শুরু করে দেয়।

আরও পড়ুন

স্বেচ্ছাচারিতা এমন পর্যায়ে গেছে যে মহাসড়কের মতো জায়গায় নির্বিকারভাবে অটোরিকশা নিয়ে উঠে যাচ্ছে মানুষ। এখানে সবাই যেন রাজা, যদিও রবীন্দ্রনাথের ‘আমরা সবাই রাজা’ গানটি নৈরাজ্য বা যথেচ্ছাচারের জয়গান নয়।

যথেচ্ছাচারের বিষয়টি যে কেবল রাস্তায় সীমাবদ্ধ তা নয়, বরং এখন আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই তা চোখে পড়ার মতো। ‘শহরে, গঞ্জে, গ্রামে এখানে ওখানে’—সবখানেই এখন যথেচ্ছাচারের বাড়বাড়ন্ত। আমরা সবাই যেন স্বাধীন।

দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে আমজনতা—সবার মধ্যেই এখন এই যথেচ্ছাচারের মনোভাব।

বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার ও আচার-আচরণ দেখলে মনে হয়, এখনো ঔপনিবেশিক যুগ চলছে। কেবল তাঁদের চেম্বারের বাইরে লেখা নেই, ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস (পড়ুন কমোনার্স) আর নট অ্যালাউড’।

যে যেভাবে পারছে, দেশকে যেন লুটেপুটে খাচ্ছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো নজির হতে পারে না।

দেশে অনিয়মটাই এমনভাবে নিয়মে পরিণত হয়েছে যে যাঁরা নিয়মকানুন মেনে চলেন, তাঁরা পরিবার ও সমাজের হাসির খোরাকে পরিণত হচ্ছেন।

অসহিষ্ণুতা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। আমাদের কেউ কিছু বলতে চাইলে আমরা বলি, এটা তো আমি জানতাম। আমরা কারও কাছ থেকে কিছু শিখব না।

আরও পড়ুন

বিশ্লেষকেরা বলেন, আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী অন্যের অধীন ছিলাম। এখন আমাদের একধরনের জেদ হয়ে গেছে, আমরা কারও অধীনতা মানব না; আমরা সবই জানি বা সবজান্তা।

নিয়ম মানাও যেন একধরনের অধীনতা। ফলে নিয়মকানুনকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া যেন স্বাধীনতা লাভের সমার্থক হয়ে গেছে।

বিষয়টি কেবল ব্যক্তিক নয়; সামষ্টিক পর্যায় থেকে সায় পাচ্ছে বলেও যথেচ্ছাচারের এই বাড়বাড়ন্ত। দেশে যে জনতুষ্টিবাদভিত্তিক ও স্বজনতোষী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে যেন মানুষকে যথেচ্ছাচার করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

কখনো কখনো মনে হয়, যাকে যা খুশি তা করতে দেওয়াই যেন এই রেজিমের টিকে থাকার মূলমন্ত্র।

একই সঙ্গে শাসনব্যবস্থা ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অভিযোগ করেন। কিন্তু সমস্যা হলো কর্তৃত্ববাদে ক্যাডারদের ওপর দলের যে নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়, আমাদের দেশে তা একেবারেই অনুপস্থিত।

অর্থাৎ কর্তৃত্ববাদী যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা দুর্বল প্রকৃতির। সেখানেই ঘটেছে বিপত্তি।

কর্তৃত্ববাদ দুর্বল হলে পুঁজি ও মুনাফা উভয়ই ভাগ হয়ে যায়। যেমন এক টাকা বিনিয়োগ করে দেখানো হতে পারে যে ১০ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, বাকি ৯ টাকা অন্যখানে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে।

আরও পড়ুন

দেশ ও জাতিকে তার গচ্চা দিতে হবে। অর্থাৎ দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিতে পারে। কর্তৃত্ববাদ নিজের সমর্থকদের শৃঙ্খলিত করতে না পারলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

আমাদের মতো দেশে কর্তৃত্ববাদের সেই ক্ষমতা নেই—দলীয় সরকার তো দূরের কথা, আইয়ুব খানের সামরিক সরকারও তা পারেনি।

১৯৬০-এর দশকে আমাদের সব পত্রপত্রিকায় প্রকাশ্যে বলা হতো, ২২ পরিবারের হাতে সব কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। তাঁরা ঋণ নিয়ে ফেরত দিতেন না। আইয়ুব খানের মতো সামরিক সরকার সেই ঋণ ফেরত আনতে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি।

এরশাদও চেষ্টা করেছেন; দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছিল তাঁর সরকার; কিন্তু সেই সরকারও সফল হয়নি। বর্তমান সরকার অনেক ক্ষমতাশালী হলেও খেলাপি ঋণের রাশ টানত পারছে না।

অর্থাৎ আমাদের ক্ষমতার বিন্যাসে কর্তৃত্ববাদ কাজ করে না। গণতন্ত্রের চর্চা যেমন দুর্বল, তেমনি কর্তৃত্ববাদের চর্চাও দুর্বল।

মিয়ানমার ও বিভিন্ন ধরনের কর্তৃত্ববাদী দেশে বিনিয়োগ বাড়লেও তার ব্যয় অনেক বেশি, অর্থাৎ ১০ টাকা বিনিয়োগ দেখানো হলেও কার্যত বাড়ে ৫ টাকা। ১০ টাকা বিনিয়োগ বাড়ছে দেখানো হলে জাতীয় আয়ও সেই অনুপাতে বাড়ছে বলে দেখানো হয়, যদিও বিষয়টি আদতে ফাঁপা।

কিছু অর্থ অন্যত্র চলে যায়—ওভারইনভয়েসিং করা হয়। এই ঋণ ফেরত না দেওয়ার মাশুল আমাদেরই দিতে হবে। সরকারের যাঁরা বন্ধু বা যাঁরা ক্ষমতাবান, তাঁরা ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না।

অনেকে বলেন, দুর্বল কর্তৃত্ববাদ দুর্বল গণতন্ত্রের চেয়েও খারাপ; দুর্বল কর্তৃত্ববাদে যে ধরনের চর্চা হয়, তা দুর্বল গণতন্ত্রের চেয়েও খারাপ। যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদ কাজ করেছে, সেখানকার ইতিহাস ভিন্ন, সেই ইতিহাসের কারণে ওই সব দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বিন্যাস বদলে গিয়েছিল। আমাদের ইতিহাস ঠিক সে রকম নয়।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ঋণ নিয়ে কেউ ফেরত দেবে না, এটা সম্ভব নয়। আমাদের এই প্রক্রিয়ায় কাগজে-কলমে কিছুদিন হয়তো উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি হবে, কিন্তু একসময় ধস নামবে, ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যা দেখা গেছে।

অনেকে বলেন, দুর্বল কর্তৃত্ববাদ দুর্বল গণতন্ত্রের চেয়েও খারাপ; দুর্বল কর্তৃত্ববাদে যে ধরনের চর্চা হয়, তা দুর্বল গণতন্ত্রের চেয়েও খারাপ। যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদ কাজ করেছে, সেখানকার ইতিহাস ভিন্ন, সেই ইতিহাসের কারণে ওই সব দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বিন্যাস বদলে গিয়েছিল। আমাদের ইতিহাস ঠিক সে রকম নয়।

বিষয়টি হলো ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া, সরকারি কার্যালয়ে ঘুষ খাওয়া আর রাস্তাঘাটে যেভাবে খুশি চলাফেরা করা—এই সবকিছুই কমবেশি একসূত্রে গাঁথা।

সেটা হলো জনতুষ্টি নিশ্চিত করতে সবাইকে যা খুশি তা-ই করতে দেওয়া, যাতে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে টিকে থাকা যায়। সে পথে আমরা অনেক দূর চলে গেছি। এরপর কী হবে, তা বলা মুশকিল।

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক