খবরের শিরোনাম কেন ভয় ও বিদ্বেষে ঠাসা

সংবাদমাধ্যমগুলো খবর পরিবেশনায় নেতিবাচকতার ওপর জোর দিচ্ছে বলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক ভাষ্যকার দাবি করছেন। তাঁদের এই কথা কি সত্য? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া সোজা নয়।

সংবাদমাধ্যমের আধেয় বা কনটেন্ট কতটা নেতিবাচক বা ইতিবাচক হওয়া উচিত, তা বাতলে দেওয়া নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তবে এটি বাৎলানোর বদলে আমরা বরং সংবাদের মধ্যে নিহিত একই ধরনের মনোভাব বা সেন্টিমেন্ট (ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক) এবং আবেগকে (যেমন ভয়, রাগ বা আনন্দ) ভিন্ন সময়ের একই প্রেক্ষাপট দিয়ে বিচার করে দেখতে পারি। তাহলে আমরা বুঝতে পারব, সংবাদমাধ্যমের আধেয় বা কনটেন্ট সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর ইতিবাচক হচ্ছে নাকি নেতিবাচক হচ্ছে, নাকি তা প্রায় একই রকম থেকে যাচ্ছে।

দুই বছর ধরে আমরা একটি গবেষণা প্রকল্পের আওতায় ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ৪৭টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত খবর থেকে ২ কোটি ৩০ লাখ শিরোনাম নিয়ে বিশ্লেষণ করেছি। এর মাধ্যমে আমরা শিরোনামগুলোতে নিহিত ইতিবাচক বা নেতিবাচক সংবেদনশীল ভাবাবেগ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি।

এই বিশালসংখ্যক শিরোনাম বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমাদের মেশিন লার্নিং মডেলগুলোর আদলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে কোন শিরোনামে আবেগ, কোন শিরোনামে সংবেদনশীল অনুভূতি নিহিত আছে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাছাই করা হয়েছে।

বিশ্লেষণে আমরা যা পেয়েছি, তা হলো ২০০০ সাল থেকে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের শিরোনামগুলোতে নেতিবাচক সেন্টিমেন্ট ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। নেতিবাচক অর্থসহ শিরোনামগুলো (যেমন ‘ব্রাজিলের কারাগারের দাঙ্গায় ঝরল ৯টি প্রাণ’) এখন প্রায় প্রচলিত হয়ে উঠেছে। অপর দিকে, ‘নতুন ধরনের কন্ট্যাক্ট লেন্সে ফিরবে দৃষ্টি, আসবে মুক্তি’—এ ধরনের ইতিবাচক শিরোনামের সংবাদ শিরোনামের সংখ্যা দিনকে দিন কমে আসছে।

মজার বিষয় হলো, আমরা যখন পরস্পরের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোকে মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ভাগ করেছি, তখন দেখতে পেয়েছি দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকা সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনামগুলো, বামপন্থীদের দিকে ঝুঁকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর খবরের শিরোনামের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি নেতিবাচক হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ২০১৩ সালের পর থেকে বামের প্রতি ঝুঁকে থাকা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামগুলোতেও নেতিবাচকতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে।

আমরা বিশ্বাস করি, মিডিয়া-শিল্পের আয় কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংবাদে ‘ক্লিক’ বাড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো শিরোনামগুলোতে ক্রমবর্ধমান নেতিবাচকতা এবং আবেগ ঢেলে দিয়ে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার সত্যভিত্তিক মান থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যও এ ধরনের শিরোনাম করা হতে পারে।

অবশ্য এমনও হতে পারে যে কুসংস্কার (যেমন বর্ণবাদ, যৌনতা এবং সমকামিতাবিদ্বেষ) এবং রাজনৈতিক চরমপন্থা (যেমন চরম ডান বা চরম বাম) জ্ঞাপক পরিভাষা ব্যবহারের আধিক্য এই তীক্ষ্ণ উত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। শিরোনামগুলোতে প্রতিফলিত সংবেদনশীল নিহিতার্থকে সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করার সময় আমরা আবিষ্কার করি, শিরোনামগুলোতে রাগ এবং ভয়ের দ্যোতনা যুক্ত করার প্রবণতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এর বিপরীতে, আবেগ-নিরপেক্ষ শিরোনামের অনুপাত কমে গেছে।

আমরা দেখেছি, ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকা আউটলেটগুলো বামপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকাদের চেয়ে বেশি রাগ প্রকাশ করা শিরোনাম ব্যবহার করে। অন্যদিকে, ভয় মেশানো শিরোনামের উত্থান এবং আবেগ-নিরপেক্ষ শিরোনামের সংখ্যা হ্রাস উভয় ধরনের মিডিয়াজুড়ে একই রকম আছে।

এখন এই ফলকে আমাদের কীভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত? আমাদের বিশ্লেষণ থেকে এটি স্পষ্ট, সংবাদ শিরোনামে নেতিবাচকতা, রাগ, দুঃখ এবং ভয়ের ছোঁয়া সময়ের সঙ্গে বাড়ছেই। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এটি কি একটি বৃহত্তর সমাজের মেজাজের প্রতিফলন, নাকি এটি শুধুই আমেরিকান নিউজরুমের নিজস্ব নীতিকেন্দ্রিক অনুভূতি ও আবেগের প্রকাশ।

আমরা বিশ্বাস করি, মিডিয়া-শিল্পের আয় কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংবাদে ‘ক্লিক’ বাড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো শিরোনামগুলোতে ক্রমবর্ধমান নেতিবাচকতা এবং আবেগ ঢেলে দিয়ে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার সত্যভিত্তিক মান থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যও এ ধরনের শিরোনাম করা হতে পারে।

আরও পড়ুন

দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকা সংবাদমাধ্যমের পরিবেশন করা খবরের শিরোনামে নেতিবাচকতা এবং ক্রোধ বাড়ার বিষয়টি লক্ষণীয়। এর কারণ কী, তা আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। একটি সম্ভাবনা হলো ঐতিহ্যগতভাবেই দক্ষিণপন্থী সংবাদমাধ্যম একই ঘটনা বর্ণনা করার সময় বামপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকা সংবাদমাধ্যমের চেয়ে বেশি নেতিবাচক ভাষা ব্যবহার করে। কিছু বিশ্লেষক যুক্তি দিয়েছেন, ডান দিকে ঝুঁকে থাকা রাজনৈতিক ভাষ্য এবং নেতিবাচক উদ্দীপনার একটি যোগসূত্র থাকে। সেটি দক্ষিণপন্থীদের দিকে ঝুঁকে থাকা সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে।

উভয় ধরনের সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে সংবাদ করার প্রবণতা বাড়লে শিরোনামে নেতিবাচকতা রাখার ধারা কমে আসতে পারে। তবে বুঝতে হবে, সেটা শুধুই সম্ভাবনা। নিশ্চিত করে এর জবাব দিতে হলে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ডেভিড রোজাডো নিউজিল্যান্ড ইনস্টিটিউট অব স্কিলস অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক

  • রুথ হিউজ ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোর মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী রিসার্চ ফেলো এবং

  • জ্যামিন হালবারস্ট্যাড একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান