ফেসবুক যে ভবিষ্যৎ তৈরি করছে তা কি আমরা চাই

ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ
ছবি: রয়টার্স

ফেসবুকের জন্য কঠিন একটা সপ্তাহ পার হলো। প্রথমে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জারের পরিষেবা ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ ছিল। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা যখন ত্রুটি সারাতে ব্যস্ত ছিলেন, সে সময়ে বিশ্বের কোটি কোটি ব্যবহারকারী তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরপর কোম্পানিটির সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউজেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির শুনানিতে অংশ নিয়ে ফেসবুকের নানা গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দেন। তিনি জানিয়েছেন, মানুষকে রক্ষার চেয়ে ফেসবুকের নজর ব্যবসার দিকে। তারা শিশুদের ক্ষতি করছে, গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

হাউজেনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুক যদিও নানা মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছে। তা সত্ত্বেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কিছু আইনগত ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটিতে হাউজেনের এ সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ইস্যুটা কত জরুরি।

এ দুটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। এটা যদি আপনার কাছে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের ক্রমবর্ধমান বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই। বর্তমানে বিশ্বের ১৮০টি দেশের ২০০ কোটি মানুষ বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। ৩৫০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। এ দুটি সাইটের মতো ইনস্টাগ্রাম জনপ্রিয় না হলেও অনেক দেশে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব বাড়ছে।

কোনো সন্দেহ নাই যে বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারীর কারণে এ সামাজিক মাধ্যমগুলো বৈশ্বিক ডিজিটাল ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর মানে হচ্ছে কোম্পানিটির অভ্যন্তরীণ কোনো সিদ্ধান্তের কারণে যদি এর অপব্যবহার হয়, সেটা অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হয়। ফেসবুকের ভেতরকার ভয়াবহ এ তথ্য প্রকাশের পর ব্যবহারকারীদের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে একটা সরল কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, ফেসবুক মানুষের যে ভবিষ্যৎটা তৈরি করছে, তার জন্য তারা কি প্রস্তুত? আমরাও কি প্রস্তুত সেই ভবিষ্যতে বাস করতে?

কেউ কেউ হয়তো এ ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক যুক্তি নিয়ে হাজির হবেন। তাঁরা বলবেন, যত দিন পর্যন্ত কোম্পানি চলবে, তত দিন পর্যন্ত সেটাকে বাড়তে দিতে হবে। আর যা–ই হোক, কোম্পানিটি তো কর্মসংস্থান তৈরি করছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি কোনোটাই সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে নয়। কোনো কোম্পানির কারণে যদি সামাজিক বিপর্যয় ঘটে, তাহলে এর কোনো মূল্যই থাকে না। কোনো কোম্পানিকে অনির্দিষ্টভাবে বাড়তে দেওয়ার যুক্তি খুব দুর্বল। বিশেষ করে হাউজেন যখন বলে দেন ফেসবুক মুনাফার প্রশ্নে নিজেদের মোটেই বদলাতে ইচ্ছুক নয়, তা সেটা সমাজকে যতই ক্ষতি করুক না কেন।

ফেসবুকের সেবা বন্ধ থাকা এবং কোম্পানিটি পরিচালনার নীতি সম্পর্কে যে তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাতে করে এ অর্থনৈতিক মডেল পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। এ ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, কোনো কোম্পানির কাছে ক্ষমতার এতটা কেন্দ্রীভবন ঠিক কিনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভবিষ্যতে কী ভূমিকা পালন করবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি।

ফেসবুক তথ্যের অভূতপূর্ব কেন্দ্রীভবন ঘটাচ্ছে। এর মাধ্যমে তথ্য নিজেদের আয়ত্তে রাখতে চায় তারা। আমরা এটা মেনে নিতে চাই না যে যোগাযোগ সহজ করার মানে হচ্ছে অসৎ উদ্দেশ্য যাদের আছে, তারাও সহজে যোগাযোগের পথ খুঁজে পাবে। ফেসবুক যে মডেলে ব্যবসা করছে, সেটার কঠোর বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। মানুষেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে তথ্য দিচ্ছে, সেটা নিয়ে ফেসবুক কী ব্যবসা করতে পারে? বাণিজ্যিক তথ্য কেন রাজনৈতিক তথ্যের চেয়ে ভিন্নভাবে ব্যবহার করা হবে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আয়ের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনই কেন একমাত্র মডেল হবে? যেসব সমাজ ও বাজারে এখনো কোম্পানিটি নিবন্ধন করেনি, কিন্তু মুনাফা ঠিকই নিয়ে আসছে, সে ক্ষেত্রে কী করণীয়? ডিজিটাল যুগ–পরবর্তী সমাজের ক্ষেত্রে এগুলো দার্শনিক প্রশ্ন। অর্থনৈতিক বিকাশের গালভরা বুলি দিয়ে এ প্রশ্নের মীমাংসা সম্ভব নয়।

ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক বড় কোম্পানি তৈরি হয়েছে, সমাজে তারা প্রভাবও তৈরি করেছে। সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে সে শূন্যতা অন্য কোম্পানি আবার পূরণ করে ফেলেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠা থেকেই ফেসবুক নিয়ে সতর্কতার শেষ ছিল না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাছে সামাজিক দায়বদ্ধতা সেখানে পরাজিত হয়েছে। শুনানিকালে হাউজেন ফেসবুক নিয়ে শক্তিশালী একটি পর্যবেক্ষণ সামনে নিয়ে এসেছেন। তঁার মতে, যতক্ষণ ফেসবুক এর লক্ষ্য বদল না করছে, ততক্ষণ ফেসবুকের কাছ থেকে পরিবর্তনটা আশা করা ঠিক হবে না। যে লক্ষ্য কোম্পানিটিকে চালিত করছে, সেটা নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির যুক্তি থেকে এসেছে। শুধু ফেসবুক নয়, অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। কোম্পানির কলেবর যেকোনো মূল্যে বাড়াতে হবে।

ফেসবুকের সেবা বন্ধ থাকা এবং কোম্পানিটি পরিচালনার নীতি সম্পর্কে যে তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাতে করে এ অর্থনৈতিক মডেল পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। এ ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, কোনো কোম্পানির কাছে ক্ষমতার এতটা কেন্দ্রীভবন ঠিক কিনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভবিষ্যতে কী ভূমিকা পালন করবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত

  • নান্যাল নেবলা কেনিয়ান লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক