ইসরায়েল এখনো বুঝতে পারছে না, তারা যুদ্ধে হেরে গেছে

গাজা সীমান্তে ইসরায়েলের সেনারাছবি: এএফপি

সম্প্রতি ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের মধ্যে আমরা যেন একটি টিভি গেম শো দেখলাম। এর নাম দেওয়া যেতে পারে ‘দ্য হোয়াইট হাউস অন উবার: হাউ টু প্রিপারচেজ আ ইউএস প্রেসিডেন্ট’। এই শোতে মনে হচ্ছিল, উপস্থাপক (ডোনাল্ড ট্রাম্প) যেন হঠাৎ ঠিক স্ক্রিপ্টে ফিরে গেছেন।

ট্রাম্প সৌদি আরবে গিয়ে বলছিলেন, উদার হস্তক্ষেপ (লিবারেল ইনটারভেনশনিজম) এক বিপর্যয় ছিল। তিনি ঠিকই বলছিলেন, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া—সব জায়গায় দেখা গেছে, কোনো দেশকে জোর করে ভেঙে আবার নতুনভাবে তৈরি করা যায় না।

ট্রাম্প ইয়েমেনের ওপর মার্কিন বোমাবর্ষণ বন্ধ করলেন এবং সিরিয়ার ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণাও দিলেন। ইরানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়েও তিনি ইঙ্গিত দিলেন।

এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আধিপত্য কায়েমের দুটি প্রধান পথ বন্ধ হয়ে গেল। এর একটি হলো সিরিয়াকে বিভক্ত করা এবং অন্যটি হলো ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো।

কিন্তু ট্রাম্পের এই অবস্থানে ইরান আশ্বস্ত হয়নি। কারণ, ইরান বহুবার এ রকম মার্কিন প্রতিশ্রুতিতে ধোঁকা খেয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রবিষয়ক আলোচনার সময় তারা বুঝে গেছে, হোয়াইট হাউস যা বলে, বাস্তবে তা সব সময় হয় না।

আরও পড়ুন

ট্রাম্প ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলার কথা বলার পর মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারাও সেই ঘোষণা শুনে চমকে উঠেছিলেন।

কারণ, নিষেধাজ্ঞা ছিল বহুস্তরবিশিষ্ট ও আইনত জটিল, যার অনেকগুলো কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া সরানো সম্ভব নয়। পুরো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সময় ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা—দুটোই দরকার।

অন্যদিকে ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরে উপসাগরীয় দেশগুলো তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ খরচ করেছে। সৌদি আরব দিয়েছে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। কাতার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে।

ট্রাম্পকে একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প পরিবারের কোম্পানির সঙ্গে জড়িত হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো বিতর্কিত চুক্তি।

এমনকি ট্রাম্পের ছেলে এরিকের জন্য দুবাইয়ে একটি টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাও হয়েছে।

ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিল, কে বেশি ট্রাম্পকে খুশি করতে পারে, তা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো একধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল।

আরব দেশগুলো যখন এই বিলাস প্রদর্শন করছিল, ঠিক সে সময়েই গাজায় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালায় ইসরায়েল।

আরও পড়ুন

১৯৪৮ সালের নাকবার (ফিলিস্তিনিদের জাতিগত উদ্বাস্তু হওয়ার দিন) বার্ষিকীতে ইসরায়েল যেন যত বেশি সম্ভব ফিলিস্তিনি হত্যা করতে চায়। ১৮ মার্চের আশপাশের কয়েক দিনে প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হয়।

গাজার খান ইউনুস এলাকায় অবস্থিত ইউরোপিয়ান হাসপাতালে হামলার উদ্দেশ্য ছিল হামাস নেতা মুহাম্মদ সিনওয়ারকে (নিহত হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ছোট ভাই) হত্যা করা। অবশ্য মুহাম্মদ সিনওয়ার নিহত হয়েছেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

এ সময়েই এক বিস্ময়কর তথ্য সামনে আসে। সেটি হলো, হামাসের বিদেশি রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল, যাতে যুদ্ধবিরতির সময়সীমা বাড়ানো এবং আরও জিম্মি মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

কিন্তু মুহাম্মদ সিনওয়ার তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, এতে যুদ্ধ বন্ধের নিশ্চয়তা ছিল না।

এখন মনে করা হচ্ছে, যদি সিনওয়ার মারা যান, তাহলে হামাসের মতো গোপন সংগঠনের জন্য নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা সহজ নয়। এতে গঠনগতভাবে একধরনের স্থবিরতা আসবে। এটি ইসরায়েলের মূল উদ্দেশ্য।

কারণ, হামাসের নেতৃত্বের কাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া গেলে ইসরায়েলের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে।

আরও পড়ুন

তবে বাস্তবতা হলো, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লক্ষ্য যুদ্ধ থামানো নয়; বরং পুরো গাজাকে ধ্বংস করে ফেলা। ২১ লাখ মানুষের মধ্যে যারা বেঁচে আছে, তাদের অনাহারে ও বোমায় মরতে বাধ্য করা—এটাই যেন ইসরায়েলের কৌশল।

এই লক্ষ্য এতটাই স্পষ্ট যে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার নিরাপত্তা পরিষদে বলে ফেলেন, ‘আর কত প্রমাণ দরকার? এবার কি আপনি সত্যিই কিছু করবেন গণহত্যা ঠেকাতে?’

বিশ্বের অনেক দেশ মুখে সমালোচনা করলেও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, আমিরাতের প্রেসিডেন্ট বিন জায়েদ, কিংবা কাতারের আমির তামিম—কারও মুখ থেকে ইসরায়েলের সমালোচনা বের হয়নি।

এই নীরবতা ছিল এক ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা, বিশেষ করে যখন ফিলিস্তিনিরা তাদের জীবন দিয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।

আসলে গাজায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছায়া দেখা যাচ্ছে। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা জিতে যাচ্ছে। বাস্তবে গাজায় তারা ভিয়েতনামের মতো এক ভয়াবহ যুদ্ধে আটকে পড়েছে।

আরও পড়ুন

আমেরিকা যেমন ভিয়েতনামে প্রতিটি যুদ্ধ জিতেছিল, কিন্তু পুরো যুদ্ধ হেরে গিয়েছিল, তেমনি ইসরায়েলও মাঠে জয় পেলেও রাজনৈতিকভাবে, নৈতিকভাবে ও কৌশলগতভাবে হেরে গেছে।

ভিয়েতনামে ৮ বছরে আমেরিকা ৫০ লাখ টন বোমা ফেলেছিল। গাজায় ইসরায়েল মাত্র এক বছরে এক লাখ টন বোমা ফেলেছে। হিসাব করলে দেখা যায়, ভিয়েতনামে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫ টন বোমা পড়েছে, আর গাজায় পড়েছে ২৭৫ টন—১৮ গুণ বেশি।

তারপরও গাজাবাসী এলাকা ছাড়েনি। উত্তর গাজা খালি করতে না পেরে ইসরায়েল এখন দক্ষিণে রাফায় লোকদের পাঠাতে চায়। যাদের পাঠানো হবে, তারা আর কখনো ফিরতে পারবে না।

এটিই ইসরায়েলের ‘অপারেশন গিডিওনের রথ’-এর মূল উদ্দেশ্য।

নেতানিয়াহু বলছেন, হয়তো যুদ্ধবিরতি হবে, কিন্তু যুদ্ধ থামবে না। তবে তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা গুরুতর এবং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন উগ্রপন্থী নাফতালি বেনেট।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল দুটি শক্তি—ভিয়েতনামিদের দৃঢ়তা ও মার্কিন জনগণের বিবেক। আজ একই ঘটনা ঘটছে গাজায়। ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমি ছাড়ছে না। তারা মরছে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করছে না।

আর পশ্চিমা বিশ্বে—বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও বামপন্থীদের মধ্যে—ইসরায়েলের বিরোধিতা প্রবল হচ্ছে। এখন আর কেউ ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ বলে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে পারছে না।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল প্রতিটি যুদ্ধে জিততে পারে। কিন্তু এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে মানবতা, ন্যায়বিচার, বিবেক ও ইতিহাসের আদালতে তারা ইতিমধ্যেই হেরে গেছে।

দ্য মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত।
ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আই-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক