শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রুখতে শ্রেণিকক্ষেই কেন পাঠ নয়

আমার ছেলের বয়স যখন আট মাস, তখন তাকে নিয়ে একদিন আমি ও আমার স্ত্রী জাপানের এক পার্কে হাঁটানোর চেষ্টা করছিলাম। সেই পার্কে খেলছিল চার-পাঁচ বছরের আরও দুই জাপানি শিশু।

আমার ছেলে ওই দুই শিশুকে দেখে, তার দিকে যেতে যাচ্ছিল। বিষয়টি বুঝতে পেরে, ওই দুই জাপানি শিশু আমার ছেলের কাছে এগিয়ে এল। প্রথমে এই দুই শিশু আমার ছেলের দুই হাত স্পর্শ করল। এরপর তারা আলতোভাবে আমার ছেলের মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে তাদের আদর এই পর্যন্ত! এর বাইরে তারা আমার ছেলেকে আর কোথাও স্পর্শ করল না।

বিষয়টি দেখার পর আমার স্ত্রী আমাকে বলল, দেখো এই ছোট শিশুরাও জানে কীভাবে ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ হয়। এরা ছোটবেলা থেকেই নিজেদের শরীরের গোপন ও স্পর্শকাতর অঙ্গ বিষয়ে কতটা সতর্ক।

হ্যাঁ, জাপানে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার পরই ওদের শেখানো হয়, কোন কোন জায়গায় স্পর্শ করে আদর কিংবা ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়, আর কোন কোন জায়গায় স্পর্শ করলে অন্যায় বা অপরাধ করা বোঝানো হয়। এই শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরাই আজ জাপানকে সভ্য ও শালীন দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

অথচ আমাদের দেশের শিশুদের এসব শিক্ষার বালাই নেই। অন্যের বাচ্চাকে কোলে নেওয়া, চুমু খাওয়া, শরীরের বিভিন্ন স্থানে টিপ্পনী দেওয়া আমাদের দেশে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ছোট্ট শিশুদের আদর করতে গিয়ে মনের অজান্তে অপরাধ করে বসি। ফলে দেশের শিশুরা যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে নিকট আত্মীয়ের দ্বারা। নিজেদের স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন না হওয়ায় স্কুলে সহপাঠী কিংবা শিক্ষকের দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছে তারা।

কয়েক দিন আগে যৌন হয়রানির অভিযোগে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর ক্যাম্পাসের দিবা শাখার এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে প্রত্যাহার করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন পড়ার পর মনে হলো, আমাদের ফুলের মতো শিশুদের শৈশব বিষময় হয়ে উঠছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিগ্রহের শিকার হচ্ছে হাজারো শিশু।

শুধু স্কুল কেন, বিভিন্ন উচ্চশিক্ষালয়গুলোয় যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা বছরজুড়েই চলে আসছে।

এ মাসের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে ওই অভিযুক্ত শিক্ষককে ‘বাধ্যতামূলক’ শিক্ষাছুটিতে পাঠায়।

আরও পড়ুন

এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে ওই বিভাগেরই এক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত সপ্তাহে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে যৌন হয়রানির অপরাধে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এক বছর আগে নিজ বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্তে এসেছে। কিছুদিন আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল দুর্বৃত্ত (শিক্ষার্থীদের) দ্বারা এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল।

শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ঘটনা নিত্যদিনই ঘটছে। পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দেওয়া, চাকরির প্রলোভন দেখানো, বিশেষ কোনো সুবিধা আদায়ের টোপে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকেরা মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠছেন। পরিবার, সমাজ কিংবা নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অধিকাংশ ঘটনাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ফলে জীবনের বিষাদময় এই সব ঘটনা বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক নারী শিক্ষার্থী।

শুধু স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ধর্মীয় শিক্ষার পর্দার আড়ালে অনেক মাদ্রাসায়ও শিশুদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে, এমন ঘটনাও নতুন নয়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকার কয়েক বছর আগে আইন পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করলেও থামছে না এই বর্বরতা।

কখনো কখনো আবার সংবাদমাধ্যম সেই সব মেয়ে সাক্ষাৎকার কোনো প্রকার গোপনীয়তা ছাড়াই প্রকাশ করছে। অথচ এই সব ঘটনায় কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এক যুগ আগে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল’ গঠন করলেও অদ্ভুত কারণে এই সব অভিযোগকারীর তথ্যের গোপনীয়তা রাখা হচ্ছে না। ফলে কোনো শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের অভিযোগ তোলার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাঁরা।

আবার অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহকর্মীরা এই সব তদন্তের দায়িত্বে থাকায় ‘ফ্রেন্ডস অব বেনিফিটের’ ঘটনাও ঘটছে। আবার অনেক সময় অভিযোগ দেওয়ার পর বছরের পর বছর সেগুলোর তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করে, ভুক্তভোগীদের মনোবল ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এই সব কারণে অনেক মেয়েই ‘প্রশাসনের কাছে’ অভিযোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন

শুধু স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ধর্মীয় শিক্ষার পর্দার আড়ালে অনেক মাদ্রাসায়ও শিশুদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে, এমন ঘটনাও নতুন নয়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকার কয়েক বছর আগে আইন পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করলেও থামছে না এই বর্বরতা।

এখান থেকে মুক্তির পথ কী? কীভাবে এই সব যৌন নিপীড়কের হাত থেকে আমাদের শিশুদের মুক্ত করা যাবে? উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েও বিবেকের শিকলে বন্দী থাকা অমানুষদের কাছ থেকে ‘শিক্ষা’র পবিত্রতা রক্ষা করা যাবে?

শুরুটা করতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। প্রাথমিকের পাঠ্যক্রমেই স্থান দিতে হবে খারাপ স্পর্শ ও ভালো স্পর্শের পাঠ। ছবি আঁকিয়ে, ডিজিটাল চিত্রে শিশুদের শারীরিক স্পর্শকাতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে হবে। কোন কোন শব্দ ও বাক্য যৌন হয়রানির অংশ, সে বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকা জরুরি। এতে তারা নিজেদের অধিকার ও স্পর্শকাতর অঙ্গ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন

আমরা যারা দেশের বাইরে শিক্ষকতা বা গবেষণায় নিয়োজিত, তাদের প্রায় প্রতিবছরই ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ও ডিসক্রিমিনেশন’-বিষয়ক কোর্স করা বাধ্যতামূলক। জাপানে যখন পড়াশোনা করেছি, তখনো এসব বিষয় যেমন অ্যাকাডেমিক নন-ক্রেডিট কোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তেমনি আমেরিকায় আসার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশের শুরুতেই আমাদের কোর্স করতে হয়েছিল।

বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোর্স করানো বাধ্যতামূলক করা সময়ের দাবি। ডিজিটাল বাংলাদেশে সবার হাতে হাতে ডিভাইস। স্কুল, কলেজে প্রায় প্রতিটি অফিসেই কম্পিউটার, ল্যাপটপ। তাই অনলাইনেই শিক্ষকদের এসব কোর্স বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

প্রতিবছর এসব কোর্স করানোর ফলে অন্তত শিক্ষকেরাও জানবেন যে তাঁরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঠিক কীভাবে আচরণ করবেন, কোন সীমারেখায় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন। কোন কোন আচরণে যৌন হয়রানি হয়, সে সম্পর্কে ধারণা পাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কর্মজীবন শুরু হয়। তাই উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের যৌন হয়রানি ও বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ক অ্যাকাডেমিক কোর্সকে পাঠক্রমে স্থান দেওয়া আবশ্যিক বিষয় হয়ে উঠেছে।

ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোর্স-কারিকুলাম সাজিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। শিগগিরই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য অনলাইন ভিত্তিক এসব কোর্স করানো ও নিজেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যেমন বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গবৈষম্য কাটানো রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার, তেমনি সেখান থেকে যৌন নিপীড়নের মতো জঘন্য অপরাধ দূরীকরণে এ ধরনের অ্যাকাডেমিক উদ্যোগ আগামী দিনে শিক্ষালয়ে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরিয়ে দেবে।

সরকার চাইলেই এই সব করা সম্ভব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বয় করে ‘অভিন্ন’ এসব কোর্স ডিজাইন করতে পারে, যা থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্যের অধিকার ও গোপনীয়তা বিষয়ে যেমন সচেতন হওয়ার সুযোগ পাবেন, তেমনি যৌন নিপীড়নবিহীন একটি সুন্দর পরিবেশের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে। স্কুলের শিশুদের মৌলিক এই সব শিক্ষা আমাদের সমাজ থেকে নিগ্রহ কমাবে, রাস্তাঘাট ও কর্মক্ষেত্রকে আরও বেশি নিরাপদ হিসেবে গড়বে।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]