এ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, এ কেমন বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন তাঁরই বিভাগের এক ছাত্রী। গবেষণাগারে ডেকে এনে ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হেনস্তার যে বিবরণ স্বহস্তে লিখেছেন ওই ছাত্রী, তা বিস্তারিত লিখতে এই লেখকের কলম সরছে না।

এ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস যখন উত্তপ্ত, অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছাত্রছাত্রীরা, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে গেল আরও এক জঘন্য ঘটনা। এখানকার একটি আবাসিক হলে এক যুবককে আটকে রেখে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ কুকর্মের সঙ্গে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েরই কয়েকজন ছাত্র। শিউরে ওঠার মতো ঘটনা, সন্দেহ নেই।

কিন্তু নিকট অতীতে এ রকম ঘটনার উদাহরণ বিরল নয়। মাত্র কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বিবস্ত্র করে ভিডিও করার মতো নির্মম পৈশাচিকতা দেখিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র ও তাঁদের সহযোগী বহিরাগত দুর্বৃত্তরা। ছাত্রীটির সঙ্গে থাকা বন্ধুটি প্রতিবাদ করলে তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয়।

আরও পড়ুন

প্রায় নিয়মিত বিরতিতে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা চাক্ষুষ করে আমরা যেন বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছি। শুধু প্রশ্ন জাগছে মনে, দেশের সবচেয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলো কি ক্রমে যৌন নিপীড়কদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে?

শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর যৌন নিপীড়নের প্রসঙ্গে পরে আসছি। বাকি যে দুটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তার দুটিই ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের দ্বারা, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের দ্বারা।

এ প্রসঙ্গে একজন মনোরোগ চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, মাত্রাছাড়া ক্ষমতার আঁচ গায়ে লাগলে অধিকাংশ মানুষের ভালোমন্দের বোধ লোপ পেতে থাকে। শুধু ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে যে ছাত্র আবাসিক হলে কর্তৃত্ব খাটাতে পারেন, নিয়মনীতি অবজ্ঞা করতে পারেন বা ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতে পারেন, তিনি নিজের ক্ষমতার দম্ভে যেকোনো ধরনের কুকর্মে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করবে না—এটাই স্বাভাবিক।

ওই চিকিৎসকের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার খুব একটা সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ, এযাবৎ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি কলেজগুলোতেও যত রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সরেজমিন অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, তার অধিকাংশরই হোতা সেই দুর্বৃত্তরা, যাঁরা নিজেদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী পরিচয় দিতে অভ্যস্ত।

তাঁদের অনেকের এমনকি সাংগঠনিক পদপদবিও আছে। যেকোনো বড় অনাচারের পর তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়, সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়, এমনকি সংগঠন তাঁদের দায়িত্ব নেবে না বলে ঘোষণাও হয়। কিন্তু ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন রোধ হয় না, তা নিয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কোনো বক্তব্য জানা যায় না। কারণ, সম্ভবত এ নিয়ে তাঁদের তদন্ত, অনুসন্ধান বা গবেষণা নেই। এই নেতৃবৃন্দের কাছে বিনীতভাবে পাকিস্তান শাসনামলের প্রবল পরাক্রমশালী ছাত্রসংগঠন এনএসএফের পরিণতির ইতিহাস স্মরণ করতে বলি।

এবার আসি শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রসঙ্গে। অধ্যাপক তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এ রকম কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেনি। কেন ছাত্রীটি এ রকম অভিযোগ করলেন, তা তিনি জানেন না। এতে তাঁর সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে, এসব কথা শোনার পর থেকেই তাঁর স্ত্রী কান্নাকাটি করছেন...ইত্যাদি।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল বিষয়টি তদন্ত করছে। সুতরাং এখনই এ বিষয়ে কাউকে দায়ী করতে চাই না। কিন্তু একটা প্রশ্ন তো উঠবেই, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের কতটা অবনতি হলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ তোলা যায়? সম্পর্কটা ওই পর্যায়ে পৌঁছাল কেন? কেন একই বিভাগের অন্য শিক্ষার্থীরাও বলছেন, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আগেও এ রকম কথা উঠেছিল, নানা কারণে তিনি পার পেয়ে গেছেন।

অধ্যাপকের বিচার চেয়ে আন্দোলনরত এক ছাত্রের বক্তব্য শুনে রীতিমতো কেঁপে উঠতে হয়। স্নাতকোত্তর শ্রেণির এই ছাত্র বলেছেন, ‘দেশের কমবেশি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা এখন একই। শিক্ষকদের নৈতিক মান এখন তলানিতে’ (প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি)।

হয়তো এটা ওই শিক্ষার্থীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, ক্ষুব্ধ উচ্চারণ। গুটিকয় শিক্ষকের আচরণের দায় পুরো শিক্ষকসমাজের ওপর চাপানো নিঃসন্দেহে অন্যায্য।

এ দেশে এখনো এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁদের নাম তাঁর শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের তো বটেই, পুরো দেশের ছাত্রসমাজের কাছে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় উচ্চারিত হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কোয়াক কোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) ২০২৪ সালে এশিয়ার শীর্ষ যে ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছে ছাত্রদের মারামারি, টেন্ডারবাজি, এমনকি ধর্ষণের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য আর শিক্ষকদের ছাত্রী নিপীড়ন বা প্রকাশ্যে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার জন্য।

তবে সময়ের সঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয় বা গুণমানের অবনতি যে ঘটেছে, এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। এর কারণ অনুসন্ধানের সময় নিশ্চয় এসেছে।

আমাদের ধারণা, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ বা দুর্নীতি এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া যে শিক্ষকেরা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন, উত্তরপত্র দেখে নম্বর দেন, ছাত্রছাত্রীদের ভাগ্য যাঁদের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের ‘অসীম’ ক্ষমতার জায়গাটিতেও কিছু করার আছে কি না, তা ভেবে দেখার সময় হয়তো এসেছে। ভারসাম্যের কিছু ব্যবস্থা তো আছেই।

যেমন কয়েকটি প্রশ্নপত্রের মধ্যে একটি বেছে নেওয়া বা উত্তরপত্রের নম্বর দুই নিরীক্ষকের মধ্যে খুব বেশি তারতম্য হলে তৃতীয়জনের কাছে পাঠানো ইত্যাদি। এসব যথেষ্ট বলে এখন আর মনে হচ্ছে না। তারপর সেগুলোও সব সময় যথাযথ অনুসরণ করা হয় না। এসব ব্যাপারে কঠোর হওয়া দরকার; না হয় আজ একজন ছাত্রী হয়তো প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের দুর্ভোগের (পড়ুন, খারাপ ফলাফল) কথা ভেবে মুখ বন্ধ রাখাই সমীচীন ভাববেন। সেটা যে আগেও অসংখ্যবার হয়েছে, এ নিয়ে তো নানা কথা চালু আছে ক্যাম্পাসেই।

শিক্ষকদের নৈতিকতা নিয়ে যখন কথা উঠলই, তখন আরও দু–একটি কথা বলা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের ‘কর্মকৃতি’র কথা নানা সময়েই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে তাঁদের স্বজনতোষণ ও দুর্নীতির কথা এখন আর লুকোছাপার মধ্যে নেই। এ মুহূর্তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের কথা মনে পড়ল, যিনি শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে গেছেন। বিস্মিত হওয়ার মতো এ রকম আরও বহু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। তাতে লেখার পরিসরই শুধু বাড়বে।

সম্প্রতি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা। অভিযোগের অন্ত নেই। উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারীর ফোনালাপ ফাঁসের কথা এখন বহুল আলোচিত, যেখানে টাকাপয়সা লেনদেনের প্রসঙ্গ আছে। নিয়োগ–বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে শিক্ষকনেতারা বলছেন, বিভিন্ন বিভাগ থেকে নতুন শিক্ষক প্রয়োজন নেই বলা সত্ত্বেও সেখানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া বা এ ধরনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার মধ্যে ‘বাণিজ্যে’র লক্ষণ দৃশ্যমান।

আর্থিক অনিয়মের এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আবাসিক হল উদ্বোধনের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৪ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়েরই মিলনায়তনে কোনো বিদেশি বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি ছাড়া অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারের ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ব্যাখ্যা চেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি কমিশন। সুতরাং শিক্ষকদের অভিযোগের ভিত্তি যে আছে, তা তো প্রমাণিত।

তবে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান বন্ধ রেখে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন সমর্থনযোগ্য মনে হয় না। শিক্ষক সমিতি এসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেনদরবার করতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জিম্মি রেখে দাবি আদায়ের এই কর্মসূচি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলেই মনে হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কোয়াক কোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) ২০২৪ সালে এশিয়ার শীর্ষ যে ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছে ছাত্রদের মারামারি, টেন্ডারবাজি, এমনকি ধর্ষণের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য আর শিক্ষকদের ছাত্রী নিপীড়ন বা প্রকাশ্যে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার জন্য।
আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কী?

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।