পিএইচডির শুরুতেই সুপারভাইজার বলেছিলেন, জীবনের সবচেয়ে কঠিন তিনটি বছরের শুরু। মাস গেলেই সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। পিএইচডি গবেষকের একটি প্রধান কাজ হলো, ওই বিষয়ে অন্য গবেষকেরা কী কাজ করেছেন, সেটা ভালো করে জানা। পথ একটাই, শত শত জার্নাল থেকে প্রয়োজনীয় পেপার খুঁজে বের করা। আর পাতার পর পাতা পেপার পড়া। ৮ থেকে ১০ পাতার একেকটি পেপার। ১০ পাতা পড়ে শেষ করার পর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেল এটা আমার কোনো কাজে লাগবে না। লেখার মুনশিয়ানার অভাবে বা বিজ্ঞানগাম্ভীর্য দেখানোর জন্য অনেক পেপারে মূল কথা অনেক জটিলভাবে বলা হয়েছে। এমনও হয়েছে, সারা সপ্তাহ ধরে পড়া ৫০টি পেপার আমার কোনো কাজে আসেনি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে হাজার হাজার পেপার পড়ে, তার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে সারাংশ তৈরি করা এখন কয়েক মিনিটের কাজ। শুধু কি পড়া, লেখাটাও অনেক সহজ হয়েছে। গল্প থেকে কবিতা। উপন্যাস বা নাটক।
আপনি শুধু বলবেন যেকোনো বিষয়ে। ছবি আঁকতে পারেন না? কোনো সমস্যা নেই। জলরং বা পেনসিল স্কেচ, যে বিষয়ে ছবি দরকার, তার বর্ণনা দিন। মুহূর্তের মধ্যেই ছবি চলে আসবে। ছবি তোলারও ঝামেলা নেই। শুধু বর্ণনা দেবেন। বর্ণনা কাল্পনিক হলেও চলবে। যেমন ধরুন, লন্ডনের বিগবেনকে আপনি পদ্মা সেতুর এক পাড়ে বসাতে চান। মুহূর্তেই সম্ভব। ভিডিও বানাতে পারবেন। চরিত্রগুলোকেও অ্যালগরিদম দিয়ে তৈরি করা যাবে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামও লেখা যাচ্ছে একাধিক ভাষায়। কয়েক মিনিটেই কোনো রকম কম্পিউটার প্রোগ্রামিং জ্ঞান ছাড়াই সাধারণ মানের ওয়েবসাইট তৈরি করা সম্ভব। যেকোনো ধরনের গ্রাফিক ডিজাইন আপনার নির্দেশ পেলেই তৈরি। আর এই নির্দেশের পোশাকি নাম হলো ‘প্রম্পট’। চ্যাটবটগুলো আপনার সঙ্গে অনায়াসে মানুষের মতো কথা চালিয়ে যাবে। আপনার নির্দেশের গুণগত মানের পরই নির্ভর করবে অ্যালগরিদমের আউটপুট।
এই কাজগুলোর জন্য আপনার কম্পিউটারের প্রয়োজন নেই। দরকার নেই কোনো কম্পিউটারের কোড জানাও। মুঠোফোন আর ইন্টারনেট থাকলেই চলবে। তবে একটা জিনিস আপনাকে জানতে হবে, ইংরেজি।
ত্রিশে এসে ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন ভ্যান গঘ। ঘরে হলেও শিশুদের নিয়ম করে এই দুটি বিষয় শেখানো উচিত। শিশুদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন। অন্যের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে শেখান। যেকোনো বিষয়ে তাদের মতামত আর মতামতের পেছনের কারণগুলো জানতে চান। নিজের মতামত দিন। মতামতের পেছনে তথ্য আর যুক্তি দিন। দেখবেন, আপনার শিশুও আস্তে আস্তে নিজের মতামতগুলো তথ্য আর যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে তুলছে। বই পড়ার অভ্যাস করুন বিভিন্ন বিষয়ে।
এই সব আউটপুটের গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বা অসত্য তথ্য দেওয়া হয়। অ্যালগরিদমের মানুষের মতো কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, নেই আবেগ বা অনুভূতি। এমনকি সত্য বা মিথ্যা বিচার করার ক্ষমতাও নেই। প্রকাশিত হাজার হাজার বই, গবেষণাগ্রন্থ আর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য নিয়ে অ্যালগরিদমকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে আউটপুট তৈরি করাই অ্যালগরিদমের একমাত্র কাজ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই অগ্রগতিতে অনেকেই উচ্ছ্বসিত। নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। চাকা, স্টিম ইঞ্জিন বা ইন্টারনেটের প্রচলনের সঙ্গেই একে তুলনা করা হচ্ছে। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজের আর জীবনযাপনের অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব পড়বে।’
অটোমেশনের কারণে বৃদ্ধি পাবে আমাদের কর্মক্ষমতা। সহজ হয়ে যাবে অনেক কাজ করা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জির গবেষণামতে, এতে করে প্রতিবছর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যুক্ত হবে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০২৫ সাল নাগাদ অন্তত ৯ মিলিয়ন নতুন কাজের সৃষ্টি হবে। তবে শঙ্কাও রয়েছে অনেক।
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৩০০ মিলিয়ন চাকরি অটোমেশনের কারণে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা বলছে, শুধু আমেরিকাতেই অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ চাকরিতে কোনো না কোনোভাবে অটোমেশনের প্রভাব পড়বে। যেসব কাজে কথা বলা, লেখা বা ডেটা এন্ট্রি জড়িত, সেই সব কাজেই প্রভাবটা বেশি হবে। কল সেন্টার বা কাস্টমার সার্ভিসের অনেক কাজই ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা জটিল ডেটা বিশ্লেষণের অনেক কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এখনই করা সম্ভব। সহজ হয়ে যাবে সাংবাদিকদের কাজ করাও। সহজ হবে বিজ্ঞান গবেষণা, বিশেষ করে নতুন ওষুধের আবিষ্কার। আমার বাবা পেশায় আইনজীবী। রাতের বেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আইনের বই খুঁজে নোট তৈরি করতেন। এই কাজ এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।
অসাম্য বাড়বে। দেখা দিতে পারে অসত্য আর অপতথ্যের মহামারি। ক্ষতিকর সফটওয়্যার তৈরি অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে এই প্রযুক্তির কল্যাণে। সম্পদ আর প্রযুক্তির মেধাস্বত্ব পুঞ্জীভূত হবে পৃথিবীর হাতে গোনা দেশ আর কোম্পানির কাছে। বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার–এ প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রকাশিত গবেষণার ৮৬ শতাংশই হচ্ছে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ আর এশিয়ার দু-একটি দেশে। এই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলতে পারলে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য তৈরি হবে মারাত্মক সংকট। ঢেলে সাজাতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা। জোর দিতে হবে ইংরেজি শিক্ষার ওপর। ইংরেজিই হতে চলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ।
সৃজনশীলতা আর গভীরভাবে চিন্তা করা শিখতে হবে। ঠিকই বলছি, এই দুটোর কোনোটিই জন্মগত নয়। চর্চার মাধ্যমে সৃজনশীলতা আর চিন্তা করার ক্ষমতা দুটোই বাড়ানো যায়। যেকোনো বয়সে। ত্রিশে এসে ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন ভ্যান গঘ। ঘরে হলেও শিশুদের নিয়ম করে এই দুটি বিষয় শেখানো উচিত। শিশুদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন। অন্যের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে শেখান। যেকোনো বিষয়ে তাদের মতামত আর মতামতের পেছনের কারণগুলো জানতে চান। নিজের মতামত দিন। মতামতের পেছনে তথ্য আর যুক্তি দিন। দেখবেন, আপনার শিশুও আস্তে আস্তে নিজের মতামতগুলো তথ্য আর যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে তুলছে। বই পড়ার অভ্যাস করুন বিভিন্ন বিষয়ে।
তথ্যের সত্যতা যাচাই, তথ্য আর অপতথ্যের পার্থক্য বোঝার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে এই প্রশিক্ষণ শুরু করা গেলে খুবই মঙ্গল।
আমাদের চারপাশের পৃথিবী খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলানোর গতি আর ধরন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের প্রচলিত ধারণা দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তবে এমন নয় যে আগামী পৃথিবীর সব কাজই সফটওয়্যার আর রোবট করবে। তবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে ক্রমাগতভাবে শেখার কোনো বিকল্প নেই। নিয়ম করে শিখে আমাদের যেতেই হবে।
ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট