আমরা কি এমন বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলাম

‘প্রতিবাদের ভাষা এমন হবে কেন?’ পরিবহন পুল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

৭ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। ভয়ংকর বিভীষিকাময় এক রাত ছিল সেটা। শাটল ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র এবং বাইরের কিছু যাত্রী। তাঁদের সবাইকে তৎক্ষণাৎ নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে উৎকণ্ঠিত তরুণদের ভিড়, গাড়ি থেকে নামছে রক্তাক্ত তরুণ ছাত্রদের শরীর।

আমরা কেউ কেউ খবর পেয়ে গভীর রাতেই চলে গেলাম সেখানে। পার্কভিউ হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ কয়েকজন ছাত্র ভর্তি ছিলেন। সেখানে দেখা গেল, এক শিক্ষক মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন এক ছাত্রের, অন্যজন সবাইকে নিজে নিয়ে যাচ্ছেন এক্স-রে আর সিটি স্ক্যান করানোর জন্য। আরেক শিক্ষক দৌড়ে এসেছেন, কোনো ওষুধ কিনে দিতে হবে কি না, তা জানতে।

আমরা সবাই যখন শাটল ট্রেন দুর্ঘটনায় মর্মাহত, আহত ব্যক্তিদের শুশ্রূষায় ব্যস্ত, ঠিক তখন আরেক দল শিক্ষার্থী একে একে ভাঙলেন আমাদের প্রতিটি পরিবহন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের প্রতিটি কাচ, হামলা করলেন শিক্ষকদের ক্লাবে, অতিথি ভবনে গিয়ে চালালেন তাণ্ডব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে এই ভাঙচুরে।

গত এক বছরে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ভাঙচুরের ঘটনা ঘটল, কিন্তু কেন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যখন জনগণের টাকায় পড়তে আসি, তখন আমাদের তো বারবার মনে রাখা উচিত যে এ দেশের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা; তবু জানি নে যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!’

আরও পড়ুন

কেন এই বিধ্বংসী আচরণ? কেন এত ক্ষোভ? এটা কি দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ? প্রচণ্ড গরমে শাটল ট্রেনে যত শিক্ষার্থী ওঠেন, তার তিন ভাগের এক ভাগেরও বসার জায়গা নেই। শহর থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ, আসার সময় নেই পর্যাপ্ত পরিবহন। তিন ঘণ্টা আগে ঘর থেকে বের হয়েও পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট পর পরীক্ষাকক্ষে পৌঁছাতে হয় শিক্ষার্থীদের—এ রকম কষ্টও আমরা দেখেছি।

পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিরাপত্তার ঘাটতি, র‍্যাগিং, হয়রানিসহ অনেক ভোগান্তি সইতে হয় শিক্ষার্থীদের। এই যুগে এসেও শিক্ষার্থীরা এ রকম পরিবেশে থাকবেন কেন? এ প্রশ্ন যৌক্তিক। কিন্তু এই সব সীমাবদ্ধতা আর সমস্যার মূল দায়ভার কি শুধুই শিক্ষকদের? তা না হলে শিক্ষার্থীরা কেন আজ শিক্ষকদের প্রতিপক্ষ ভাবছেন?

প্রতিবাদের ভাষা এমন হবে কেন? সত্তর বা আশির দশকেও তো প্রতিবাদ ছিল। প্রতিবাদ হতো স্লোগানে, মিছিলের উত্তাপে, পথনাটকে, ব্যানারে আর মানববন্ধনে। এখন কেন শিক্ষকের বাসা ভেঙে তছনছ করা হবে? আমাদের মনে আরও প্রশ্ন জাগে, এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কখনোই শাস্তি হয় না কেন? কেন তাঁরা বিচারহীনতা আর দায়মুক্তির সুবিধা পান? আমরা কি এমন বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলাম? আমরা কি এমন শিক্ষা দিয়েছিলাম?

কেন ভাবা হয় না, এত এত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত আবাসন, গবেষণা আর পড়াশোনার সুযোগ তৈরি না করলে দিন দিন অসন্তোষ বাড়বে? কেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রদের ন্যূনতম সুযোগগুলো আমাদের কাছে প্রাধান্য পাবে না? ঘোষণা আসে, তবু স্বপ্নের সেই ট্রেন কেন আসে না? ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কয়েক শ আসনের শাটল ট্রেন কেন? এর উত্তর আমাদের কারও জানা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যখন ছাত্রসংখ্যা ও চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে কেন আসে খরচ কমানোর তাগিদ? অথচ উন্নয়ন চাইলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস ও শাটল ট্রেন চালু করার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার সময় হয়েছে এখন।

আরও পড়ুন

ভাঙচুরের ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের কিছু মন্তব্য ছিল এ রকম, ‘শিক্ষকদের বাস ভাঙা ঠিক হয়েছে,’ অথবা ‘আসুক এবার শাটলে করে স্যাররা।’ একজন লিখেছেন, ‘টিচারদের সব বাসে আগুন দেওয়া উচিত।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘আমরা কষ্ট করব, ওরা আরামে থাকবে কেন?’ মন্তব্যগুলো পড়ে শিক্ষক হিসেবে স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় আছে কি! আমরা এত খারাপ? আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত চান শিক্ষার্থীরা?

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই হচ্ছেন তাঁর ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের অন্যতম। আমাদের সমবয়সী বন্ধুরা যখন জেলা প্রশাসক হয়ে সরকারের টাকায় পাজেরো গাড়িতে চড়েন, যখন বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা হয়ে অর্ধকোটি টাকার গাড়ি হাঁকান, তখন ৪০ জন শিক্ষক গাদাগাদি করে একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাটা কি খুব ভয়ংকর অপরাধ?

প্রতিবাদের ভাষা এমন হবে কেন? সত্তর বা আশির দশকেও তো প্রতিবাদ ছিল। প্রতিবাদ হতো স্লোগানে, মিছিলের উত্তাপে, পথনাটকে, ব্যানারে আর মানববন্ধনে। এখন কেন শিক্ষকের বাসা ভেঙে তছনছ করা হবে? আমাদের মনে আরও প্রশ্ন জাগে, এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কখনোই শাস্তি হয় না কেন? কেন তাঁরা বিচারহীনতা আর দায়মুক্তির সুবিধা পান? আমরা কি এমন বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলাম? আমরা কি এমন শিক্ষা দিয়েছিলাম?

সবকিছুই পরদিন থেমে গেছে। আবার ক্লাস হচ্ছে, আবার ছাত্ররা আসছেন। কিন্তু সকালে যখন কাচের টুকরাগুলো দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল, আমরা অপমান করেছি আমাদের সেই কৃষক, আটপৌরে স্কুলশিক্ষক কিংবা মধ্যবিত্ত বাবাকে, যাঁরা নিজের কষ্টে আয় করা টাকা থেকে কর দেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ইট, প্রতিটি বাস, প্রতিটি জানালার মালিক এ দেশের কোটি কোটি মানুষ। এটি কোনো উপাচার্যের নিজস্ব সম্পদ নয়, কোনো প্রভাবশালী শিক্ষকেরও নয়।

  • আদনান মান্নান, মৌরী দে, মো. মাহবুব হাসান, অনুপম দাশ গুপ্ত, মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হক, তানজিনা শারমিন, সুমন ভট্টাচার্য, অনুপম কুমার দাশ, কাজী তানভীর আহাম্মদ, শান্ত বণিক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান, প্রকৌশল ও বাণিজ্য অনুষদের তরুণ শিক্ষক ও গবেষক