‘আজ (গতকাল সোমবার) গণিত পরীক্ষা ছিল। তবে হবে না, এটা জানতাম না। এসে দেখি, পরীক্ষা হচ্ছে না।’ খুলনা জিলা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোকে বলছিল সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সরফুদ্দিন আয়ান।
১ ডিসেম্বর সকালবেলায় স্কুলের গেটে গিয়ে ‘১ এপ্রিলের’ ধোঁকা খাওয়ার অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে আয়ানকে। তার মতো সারা দেশে হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে অকালবোধনের মতো এই ‘অকাল এপ্রিল ফুল’ যাঁরা ‘উপহার’ দিয়েছেন, তাঁরা আর কেউ নন, তাঁরা তাদের শিক্ষক।
সকালে স্কুলে এসে ‘ধোঁকা খেয়ে’ বাড়ি ফেরার জন্য শিক্ষকদের কেউ কেউ অবশ্য আয়ানকেই দায়ী করে বসতে পারেন। বলতে পারেন, এক দিন আগেই তো পরীক্ষা হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোকার মতো সে পরীক্ষা দিতে গেল কেন?
ঘটনা যা দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, আয়ানরা তো বটেই, আয়ানদের মা–বাবাও মহাবোকা। আর বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন হলেন তাঁদের শিক্ষকেরা! তা না হলে নিজেদের ‘বিসিএস ক্যাডারের মর্যাদা’ ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য তাঁরা শিক্ষার্থীদের এইভাবে ঢাল বানাতে পারতেন না।
ঘটনা হলো, বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি নামে যে সমিতি আছে, সেই সমিতির সদস্যরা পরোক্ষভাবে বলে দিয়েছেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে তাঁরা আঙুল বাঁকা করবেন। সেই প্রধান ‘ঘি’ হলো সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করে ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের’ গেজেট প্রকাশ। এর পাশাপাশি আরও তিনটি দাবি বা তিন ধরনের ‘ঘি’ আছে। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের দাবি না মানা হলে আজ সোমবার থেকে তাঁরা লাগাতার কর্মবিরতিতে যাবেন। আর সোমবারই ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। এখানে ‘কর্মবিরতি’র মতো সুশীল কথার ‘বাংলা’ মানে হলো, ‘হয় দাবি মানো, নয়তো শিক্ষার্থীদের সব পরীক্ষা বন্ধ।’
দেখা যাচ্ছে, ৫ আগস্ট–পরবর্তী সরকারের আমলে আর যা-ই হোক, সব দাবিদাওয়ার আন্দোলন যে অতি উচ্চফলনশীল হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
উল্লিখিত সমিতিটির নেতা মোহাম্মদ ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকার যদি দাবি পূরণের বিষয়ে রূপরেখাসহ সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে তাঁরা ‘শিক্ষার্থী ও জাতীয় স্বার্থে’ কর্মবিরতি রাখবেন না। সমিতির আরেকজন নেতা বলেছেন, সরকার দাবি মেনে নিলে সপ্তাহের ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বাকি পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে। তার মানে এখানে শিক্ষার্থীদের সুবিধা–অসুবিধা দেখার সুযোগ নেই।
সুস্থ বিবেচনার চোখ দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই শিক্ষকেরা কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক একাডেমিক যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছেন, তাকে আর আন্দোলন বলা যায় না। গোটা দেশে মাধ্যমিক স্তরে লাখ লাখ শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছে, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা আটকে গেল। তার মানে একটা পরিবারে একটি সমাজে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কেউ পরীক্ষা দিচ্ছে, কেউ দিতে পারছে না। যাদের পরীক্ষা আটকে গেল তাদের মানসিক পরিস্থিতির কথাটা ভাবুন, তাদের অভিভাবকদের কথা ভাবুন।
শিক্ষকেরা ভুলে যাচ্ছেন, একজন শিক্ষার্থীর জন্য বার্ষিক পরীক্ষা কেবল একটি রুটিন ইভেন্ট নয়। এটি তার সারা বছরের পরিশ্রমের মূল্যায়ন। এটি তার আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠি। এটি তার ভবিষ্যতের একটি ধাপ। সেই পরীক্ষাই যখন স্রেফ নিজেদের টাকাকড়ির দাবির অজুহাতে আচমকা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন সবচেয়ে বড় আঘাতটি যায় শিক্ষার্থীদের মানসিকতায়। জন্ম নেয় ভয়, অনিশ্চয়তা, হতাশা ও ক্ষোভ।
সমিতির নেতারা, সদস্যরা ও সমর্থকেরা তাঁদের নিয়োগের সময় জানতেন, পদটি দশম গ্রেডের। জেনেই তাঁরা আবেদন করেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন, নিয়োগপত্র গ্রহণ করেছেন, যোগদান করেছেন। এরপর কেন তাঁরা মনে করছেন তাঁদের প্রতি ‘অবিচার’ করা হয়েছে! হ্যাঁ, রাষ্ট্রের প্রতি দাবি তাঁরা করতেই পারেন, এটি গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তাঁদের চাই নবম গ্রেড, চাই বিসিএস ক্যাডারের মর্যাদা! সেই দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত?
বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ রাত জেগে, পরিবার-সমাজ ত্যাগ করে বছরের পর বছর ধরে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেন। তাঁদের সেই লড়াইকে অগ্রাহ্য করে যাঁরা শুধু মিছিল, স্লোগান আর কর্মবিরতির জোরে ক্যাডার হতে চান, তাঁরা কি একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরেই বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন না?
গতকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়েও মূল বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সেখানেও অনেক জায়গায় পরীক্ষা বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করেছেন প্রাথমিকের একাংশের শিক্ষক। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বেতন ‘আপাতত’ ১১তম গ্রেড দেওয়াসহ তিন দফা দাবিতে ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ ব্যানারে এ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। সংগঠনটির বক্তব্য, দাবি বাস্তবায়নের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় তৃতীয় প্রান্তিক মূল্যায়ন (বার্ষিক পরীক্ষা) বর্জন কর্মসূচি চলবে। পরীক্ষার জন্য সন্তানকে স্কুলে নিয়ে এসে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ে কোথাও কোথাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অভিভাবকেরা। কোথাও অভিভাবকেরাই নিজেদের সন্তানদের পরীক্ষা নিজেরাই নিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ১৬ মাসের মধ্যে ছয় মাসই বেতন বৃদ্ধি, গ্রেড উন্নয়ন, জাতীয়করণ ও এমপিওসহ নানা দাবিতে পাঠদান বন্ধ করে আন্দোলন করেছেন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এমপিওভুক্ত, নন–এমপিওভুক্ত, ইবতেদায়ির শিক্ষকেরা। এতে প্রায় আড়াই কোটি শিক্ষার্থী নজিরবিহীন শিখন ঘাটতির কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মনে করিয়ে দরকার যে, করোনা মহামারির ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষার এসব স্তর।
শিক্ষকেরা ভুলে যাচ্ছেন, একজন শিক্ষার্থীর জন্য বার্ষিক পরীক্ষা কেবল একটি রুটিন ইভেন্ট নয়। এটি তার সারা বছরের পরিশ্রমের মূল্যায়ন। এটি তার আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠি। এটি তার ভবিষ্যতের একটি ধাপ। সেই পরীক্ষাই যখন স্রেফ নিজেদের টাকাকড়ির দাবির অজুহাতে আচমকা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন সবচেয়ে বড় আঘাতটি যায় শিক্ষার্থীদের মানসিকতায়। জন্ম নেয় ভয়, অনিশ্চয়তা, হতাশা ও ক্ষোভ।
শিক্ষকদের হয়তো একটি বেতন স্কেল আটকে আছে। তাঁদের বঞ্চনা–গঞ্জনার শেষ নেই আমরা জানি। শিক্ষাখাতের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়নের বিষয়টি অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু তাঁদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের জন্য একটি প্রজন্মের স্বপ্নে যে ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে, তার দায় কে নেবে?
আন্দোলনরত শিক্ষকদের মনে রাখা দরকার, তাঁরা সরকারি সুবিধাভোগী কর্মচারী। সরকারের সঙ্গে তাঁদের যে চুক্তি হয়েছিল, তা লঙ্ঘন করে কোমলমতি শিশুদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের প্রয়াস শিক্ষকতা নামের মহান পেশার সঙ্গে মানানসই নয়।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
