মতামত
ভারতের উদ্বেগে আমরা যত আন্তরিক, তারা তত নয়
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় খাতরা ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে একই দিন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁদের এ সফর বাংলাদেশের রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় খাতরার বাংলাদেশ সফরের হয়তো কিছু রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে। কিন্তু এটিকে আমি বাংলাদেশ-ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবেই মনে করি।
বিনয় খাতরা এসেছেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব যখন দিল্লিতে যান, তখন ভারতের ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি দেশটির পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয়।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ভারতের আস্থা রয়েছে। এটি সৌজন্যমূলক কথাও হতে পারে, আবার অর্থবহ কথাও হতে পারে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যে যোগাযোগ চলছে, সেটা ভারতের প্রত্যাশামাফিকই হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিনয় খাতরা। আমার কাছে মনে হয়, বেশ কিছুদিন ধরেই দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে রয়েছে। তবে পুরো বিশ্ব বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক মূল্যায়ন করে—তাঁর এ বক্তব্য বোধগম্য নয়। ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বিশ্বে বাংলাদেশেরও একধরনের গুরুত্ব রয়েছে। এ হিসেবে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক কেমন যাচ্ছে, সেদিকে অন্যরা তাকাবে, সেটা খুব অস্বাভাবিক বিষয় নয়। বিশেষ করে চীন অবশ্যই নজর রাখবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও সেটা দেখবে।
সীমান্ত হত্যার ব্যাপারে একসময় দুই পক্ষ থেকেই বলা হতো, এটি শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু ইদানীং, ভারতের ক্ষমতাসীন কারও কারও কাছ থেকে বরং উল্টো কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে চেপে বসা বিরাট একটি সমস্যা। কিন্তু এ প্রশ্নে ভারত একধরনের লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। দরকার ছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করা।
দ্বিপক্ষীয় সব বিষয় বিবেচনায় নেবে ও সমাধানের চেষ্টা করবে—ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ধরনের একটি ঘনিষ্ঠ ও ভালো সম্পর্ক আমরা চাই। কিন্তু একটা বিষয় বলতে না চাইলেও বলতে বাধ্য হই যে গত ১২-১৪ বছরে ভারতের যেসব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল, সেগুলো বাংলাদেশ যত আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধান করেছে, ভারতের পক্ষ থেকে সে রকম আন্তরিকতা আমরা দেখতে পাইনি। ভারত সব সময় বলার চেষ্টা করে, প্রতিবেশী প্রথম।
কিন্তু আমরা যখন বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিই, তখন এই বক্তব্যের প্রতিফলন খুব একটা দেখতে পাই না। কেননা বাংলাদেশের জন্য প্রতীকী গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো প্রয়োজন ভারত মিটিয়েছে, তেমনটা দেখা যায় না। তিস্তা চুক্তির কথাই ধরা যাক। প্রায় হয়ে যাওয়া চুক্তিটি, এত বছরেও হলো না। এর কারণ কী? তিস্তা চুক্তি অপ্রয়োজনীয় বা অযৌক্তিক, সেটা ভারত বলছে না। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে।
সীমান্ত হত্যার ব্যাপারে একসময় দুই পক্ষ থেকেই বলা হতো, এটি শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু ইদানীং, ভারতের ক্ষমতাসীন কারও কারও কাছ থেকে বরং উল্টো কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে চেপে বসা বিরাট একটি সমস্যা। কিন্তু এ প্রশ্নে ভারত একধরনের লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। দরকার ছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করা।
আগামী সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ১৮তম আসরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। এ আমন্ত্রণটি দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। সম্মেলনের সাইডলাইনে যদি অন্যান্য দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেখা–সাক্ষাতের ব্যবস্থা থাকে, সেটা বাংলাদেশের জন্য উপকারী হবে।
দুই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সব সময় চাই সম্পর্ক সুন্দর থাকুক, ভালো থাকুক এবং পারস্পরিক স্বার্থ যেন দুই পক্ষই দেখভাল করে। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে। কেননা আমরা অনেক কিছু পরিবর্তন করতে পারি, কিন্তু প্রতিবেশীকে পরিবর্তন করতে পারি না।