মতামত
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় খাতরা ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে একই দিন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁদের এ সফর বাংলাদেশের রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলের ঢাকা সফরটি দুই কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এর দৃশ্যমানতা। এ সফরে তিনি একা আসেননি, তাঁর সঙ্গে একটি উচ্চপর্যায়ের টেকনিক্যাল টিম ছিল; যাঁদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন। ডেরেকের এই সফর এমন নয় যে তাঁরা কিছু কথা বলে গেলেন এবং বাংলাদেশে তাঁদের প্রতিপক্ষের কথা শুনলেন।
এ আলোচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব একটা মূল্যায়নের চেষ্টা থাকবে। শোলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের দপ্তরে তাঁর উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেন। ফলে এ সফর আলাদা গুরুত্ব বহন করে। বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলেও শোলের সফরকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে বলে ধারণা করি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে, আমরা জানি না। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ডেরেক শোলে পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, প্রক্রিয়াগত দিক থেকে নির্বাচনটি কেমন হয়েছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কী ধারণা পোষণ করে। তাদের কাছে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হলো কি না। ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেছেন, এ ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অনেক সুযোগও আছে।
সেসব নিয়েও দুই দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সুদৃঢ় সম্পর্ক আছে। যেসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুর্বলতা ও ঘাটতি আছে, সেসব দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও সীমিত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক জোরদার হবে কি না, তা নির্ভর করবে আমাদের আত্মোপলব্ধির ওপর। এখানে আত্মসন্তুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আরেকটি কথাও আলোচনায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে যে গণতন্ত্র সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে ১১০টি দেশ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ পায়নি।
বলা দরকার যে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বহুমাত্রিক। বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক সম্প্রসারণের অনেক সুযোগ আছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৯ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে; যা একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি।
ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে কি না, তা নির্ভর করবে এখানে আইনের শাসন সংহত হওয়া, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু থাকা ও মানবাধিকার সুরক্ষার ওপর। অর্থনৈতিক সম্পর্কটি যুক্তরাষ্ট্র সব সময় মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে থাকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক জোরদার হবে কি না, তা নির্ভর করবে আমাদের আত্মোপলব্ধির ওপর। এখানে আত্মসন্তুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। আরেকটি কথাও আলোচনায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে যে গণতন্ত্র সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে ১১০টি দেশ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ পায়নি।
বলা হয়েছে, যেসব দেশ গণতন্ত্রের রোডম্যাপ বা পথনকশা দিয়েছে, সেসব দেশকেই এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রতি যে আমরা কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেই প্রশ্নও সামনে আসে। মনে রাখতে হবে বিশ্ব এখন গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক—এই দুই শিবিরে বিভক্ত। মানুষ দেখবে, ১১০টি দেশ সম্মেলনে গেছে, বাংলাদেশ যায়নি। গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে গত বছরও একই প্রশ্ন উঠেছিল।
ডেরেক শোলের এই সফর আরও একটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। সেটি হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের নিরন্তর আগ্রহ। শুরু থেকে তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সমর্থন জানিয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের জন্য যে মানবিক সহায়তা এসেছে, একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি দিয়েছে।