পশ্চিমারা যে কারণে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে একজোট

যুক্তরাষ্ট্রের রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ডকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার ও দখলদার ইসরায়েলি সেনাদের যুদ্ধ দ্বিতীয় দিন গড়াতে না গড়াতেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইসরায়েলকে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার নৌ সেনাসহ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আধুনিক রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ডকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে রওনা হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জেরাল্ড আর ফোর্ডের সঙ্গে একটি ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যুদ্ধজাহাজ এবং চারটি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসকারী জাহাজ রয়েছে।

অস্টিন বলেছেন, এই বহরের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষিপ্রগতির এফ-৩৫ বিমানের পাশাপাশি এফ-১৫, এফ-১৬ এবং এফ-১০ ফাইটার জেট পুরো এলাকা ঘিরে রাখার জন্য যুক্ত থাকবে।

অস্টিনের বক্তব্যে এটি পরিষ্কার হয়েছে, জর্ডান, বাহরাইন, কাতার, সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোতে থাকা মার্কিন ঘাঁটির সেনাদেরও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব অস্ত্র, সরঞ্জাম ও সেনা শুধু প্রদর্শনীর জন্য ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় পাঠানো হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের যুদ্ধজাহাজ এই প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনি উপনিবেশে পাঠানো হয়েছে, মোটেও তা নয়। সেই ১৮৫৪ সালে এক দল শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান উগ্রপন্থী প্রোটেস্ট্যান্ট জাফায় (বর্তমান তেল আবিবের পাশের একটি এলাকা) ‘আমেরিকান মিশন কলোনি’ গড়ে তুলেছিল। ১৮৫৮ সালে তাদের সেই অবৈধ বসতিতে আদিবাসী ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধমূলক আক্রমণ করেছিলেন।

ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএস ওয়াবাশ নামের একটি বাষ্পচালিত নৌবহর পাঠিয়েছিল। তৎকালীন অটোমান শাসকেরা যেন মার্কিন নাগরিকদের হত্যার বিচার করেন, সেই দাবিতে তারা ফিলিস্তিনের উপকূলে আমেরিকান পতাকা উড়িয়েছিল। এর দুই দশক পর ফিলিস্তিনের উপকূলে ঘাঁটি গাড়া ধর্মান্ধ জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট উপনিবেশবাদীদের রক্ষার দাবিতে জার্মানরাও একই কাজ করেছিলেন।

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যে একজোট হয়েছে, সেটি মোটেও কাকতালীয় বিষয় নয়। নামিবিয়া, তাঙ্গানিকা, রোডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, কেনিয়াসহ যত জায়গায় শ্বেতাঙ্গরা উপনিবেশ গড়েছিল, সবখানে তারা একজোট হয়েছিল। এর কারণ হলো তারা প্রচণ্ড রকম বর্ণবাদী। ইসরায়েল যেহেতু একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র, সেহেতু তারা তাদের পাশে থাকবেই।

১৮৭৭-১৮৭৮ সালে অটোমান-রাশিয়ার যুদ্ধের সময় ‘টেম্পলারস’ নামের জার্মান ধর্মীয় ঔপনিবেশিকদের রক্ষায় ফিলিস্তিন উপকূলে জার্মান যুদ্ধজাহাজগুলো ভিড়েছিল। এই টেম্পলারদের বসতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জার্মান কনসাল অটোমানদের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়েছিল। ওই সময় টেম্পলাররা ফিলিস্তিনকে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর আশা করেছিল। তারা আশা করেছিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দখল করা ফিলিস্তিনকে জার্মানি তাদের উপহার হিসেবে দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় তারা আশাহত হয়।

এর তিন দশক পর ১৯০৮ সালে কনস্ট্যান্টিনোপলে তরুণ তুর্কিদের জাগরণের সময় ফিলিস্তিনি কৃষক সম্প্রদায় জার্মান উপনিবেশে হামলা চালায়। আবারও জার্মানি হাইফা এলাকায় যুদ্ধজাহাজ পাঠায় জার্মান উপনিবেশকে সহায়তা করার জন্য। এরপর সেখানে আরও কয়েক দফা হামলা চালায় ফিলিস্তিনিরা।

আরও পড়ুন

১৯৭৩ সালে মিসর ও সিরিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘটিত যুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে কয়েক সপ্তাহ আগে ইসরায়েল সেই যুদ্ধসংক্রান্ত বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলের দখল করা গোলান উপত্যকা ও সিনাই উপদ্বীপ স্বাধীন করার জন্য সে সময় মিসর ও সিরিয়া যুদ্ধে নেমেছিল। সেই যুদ্ধসংক্রান্ত নথিতে ইসরায়েলকে সে সময় পশ্চিমা দেশগুলোর সরাসরি সহায়তা দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। সে সময় ইসরায়েলকে সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছিল আমেরিকা।

সম্প্রতি জেরুজালেম পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘আমরা শুরু থেকেই আরবদের জয় ঠেকাতে বদ্ধপরিকর ছিলাম।’ কিসিঞ্জারের মতোই বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বর্তমানে চলমান যুদ্ধের প্রথম দিনেই বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা যা কিছু দরকার, তার সবই করব।’

আরও পড়ুন

১৯৪৮ সালে যেভাবে জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনবিরোধী মিছিল সমাবেশ ও প্রচার শুরু হয়েছিল, এবারও ইসরায়েলি দখলদার বসতি স্থাপনকারীদের সমর্থনে তা শুরু হয়েছে। জার্মানরা ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠত্ববাদী ইহুদি নেতাদের উদ্দেশে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘বার্লিন তোমাদের সঙ্গে আছে।’ ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যেও সেই স্লোগানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যে একজোট হয়েছে, সেটি মোটেও কাকতালীয় বিষয় নয়। নামিবিয়া, তাঙ্গানিকা, রোডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, কেনিয়াসহ যত জায়গায় শ্বেতাঙ্গরা উপনিবেশ গড়েছিল, সবখানে তারা একজোট হয়েছিল। এর কারণ হলো তারা প্রচণ্ড রকম বর্ণবাদী। ইসরায়েল যেহেতু একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র, সেহেতু তারা তাদের পাশে থাকবেই।

আরও পড়ুন

ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সর্বশেষ প্রকাশ পেয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়ভ গ্যালান্টের কথায়। তিনি এক ভাষণে ফিলিস্তিনিদের ‘মানবরূপী জানোয়ার’ বলে উল্লেখ করেছেন।

যেহেতু এশিয়ায় বর্ণবাদী ও শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সর্বশেষ উপনিবেশ রাষ্ট্র ইসরায়েল, সেহেতু সেই উপনিবেশকে পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা টিকিয়ে রাখতে চাইবেই।

 মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

  • জোসেফ মাসাদ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক

আরও পড়ুন