চীনের মতো পরাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম ভারতের

মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয় চীন
ছবি: রয়টার্স

১৯৮৫ সালের মার্চে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়েছিল। ‘রাজীব রিগ্যান’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে পত্রিকাটি ঘোষণা করেছিল, রাজীব বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে এবং কর ছাঁট দিয়ে ‘ছোটখাটো বিপ্লব’ ঘটিয়ে দিয়েছেন।

এর তিন মাস পরে যুক্তরাষ্ট্রে রাজীবের সফরের সময় কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীর ভাষ্য ছিল আরও প্রশংসামুখর। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘আজকের চীনের চেয়ে ভারতে আরও অনেক বড় অর্থনৈতিক বিস্ময়ের সূচনা হতে চলেছে। সেই বিস্ময়কর ঘটনা যদি ঘটেই যায়, তার মধ্যমণি হবেন এই তরুণ প্রধানমন্ত্রী।’ রাজীব গান্ধীর কর ছাড় ও অর্থনৈতিক শর্ত শিথিলের নীতিরও তিনি অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন।

আরও পড়ুন

১৯৮০–এর দশকের শুরুটা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কারণ, ওই সময় কার্যত অভিন্ন মাথাপিছু আয়ের এই দুটি সর্বাধিক জনবহুল দেশ তাদের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছিল। দুটি দেশই ‘বিপ্লব’ ও ‘বিস্ময়কর’ কিছু একটা করতে যাচ্ছে বলে বিশ্ববাসীর মনে ধারণা জন্মাচ্ছিল। কিন্তু চীন যখন মানব–পুঁজির উন্নয়নের শক্ত ভিতের ওপর দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল, তখন ভারত তার প্রবৃদ্ধির এই দিকটিকে, অর্থাৎ মানবসম্পদকে খাটো করেছে। চীন এরপর অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়েছে। অন্যদিকে ভারত যতটা শোর তুলেছিল, সে তুলনায় খুব কমই অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দুই দেশের ব্যবধানের পরিসর বেড়েছেই। ১৯৮১ সালে ভারতের নাগরিকদের গড় আয়ু ছিল ৫১ বছর। অন্যদিকে চীনের নাগরিকদের গড় আয়ু ছিল ৬৪ বছর। বিশ্বব্যাংক সে সময় চীনের এই গড় আয়ুকে ‘অসামান্য উচ্চমাত্রার’ সাফল্য বলে অভিহিত করেছিল।

বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ভারতের নাগরিকদের তুলনায় চীনের লোকেরা ভালো খেতে পারছে। এ ছাড়া চীন প্রায় সর্বজনীনভাবে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে পেরেছে এবং দেশটির নারীরাসহ সব নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে তখন বলা হয়েছিল, মাও সে–তুংয়ের আমলে চীন লিঙ্গসমতার দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে জোর দিয়েছিল। নিকোলাস ক্রিস্টোফ ও শেরিল ইউডান তাঁদের যৌথভাবে লেখা বই হাফ দ্য স্কাই–এ উল্লেখ করেছেন, চীন (বিশেষ করে দেশটির শহর অঞ্চল) ‘নারীদের বেড়ে ওঠার সেরা জায়গা’ হিসেবে গড়ে উঠেছে। শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি জন্মহার কমিয়েছে এবং শিশু পালন পদ্ধতিকে উন্নত করেছে।

শিল্পবিপ্লবের সূচনালগ্ন থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিটি দৃষ্টান্ত (যার মূল ভিত্তি হলো টেকসই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি) মানবসম্পদ খাতে বিনিয়োগ ও কর্মশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর সঙ্গে সম্পর্কিত। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাজারের উদারীকরণ চীনা ও ভারতীয় প্রবৃদ্ধিকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। তবে চীন মানবসম্পদ এবং লিঙ্গসমতা—এ দুটি স্তম্ভের ওপর তার সফল উন্নয়ন কৌশল গড়ে তুলেছে; যেখানে ভারত অনেক পিছিয়ে আছে।

আরও পড়ুন

এমনকি চীন আরও বাজারমুখী হওয়ার পরও, দেশটি তার জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলার মতো উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক কর্মশক্তি সৃজনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মান বাড়াতে তারা যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের মানবসম্পদ সূচকে (যা ০ থেকে ১ স্কেলে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অগ্রগতি পরিমাপ করে) ভারতের স্কোর ছিল ০.৪৯, যা নেপাল ও কেনিয়ার মতো অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশের চেয়ে কম। অন্যদিকে চীনের স্কোর ছিল ০.৬৫। বর্তমানে চীনের উৎপাদনক্ষমতা ভারতের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ৪৫ শতাংশ ভারতীয় শ্রমিক এখনো অনুৎপাদনশীল কৃষি খাতে রয়েছেন। অন্যদিকে চীন উৎপাদন খাতে তার শ্রমশক্তি নিয়োগের হার বাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী গাড়ির বাজারে, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহনে একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে এই জনসম্পদ কাজ করেছে।

১৯৮০–এর দশক থেকে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, উন্নয়ন ও অগ্রগতির দৌড়ে শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্ববাদী চীনা খরগোশ হেরে যাবে এবং গণতান্ত্রিক ভারতীয় কচ্ছপেরই জয় হবে। জিরো কোভিড নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যে কড়াকড়ি আরোপে চীনের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ায় অনেকে এই ধারণাকে সঠিক বলে ভাবেন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, চীন তার দক্ষ মানবসম্পদের শক্ত ভিতে দাঁড়িয়ে আছে, যা ভারতের হাতে নেই। ফলে ভারতের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়ার সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

● অশোক মোদি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক পলিসির ভিজিটিং

আরও পড়ুন