রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে রাস্তার ধারে পুকুরপাড়ে ছোট ছোট কিছু খুপরি। ঠিক খুপরি নয়, নৌকার ছই কিংবা গরুর গাড়ির ছইয়ের মতো নীল-কালো পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ছোট ছোট ঘর। তারই একটিতে পলাশ মুর্মু তাঁর দুই সন্তান এবং স্ত্রীকে নিয়ে কয়েক বছর ধরে বসবাস করেন। পলাশ মুর্মুসহ আরও সাত-আটটি পরিবার এখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। কারও আদি নিবাস চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে, কারও নাচোলে, কারও নওগাঁর পোরশায়। সেখানে তাঁদের নিজস্ব কোনো জায়গাজমি নেই, কাজ নেই, খাবার নেই। চারদিকে ক্ষুধা আর অভাব। জীবিকার সন্ধানে, জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাঁরা জন্মভূমি ছেড়েছেন। এখানে অন্তত দিনে একবেলা আহার জুটছে।
বসন্তের ভরদুপুর। খালি গায়ে পলাশ মুর্মু পুকুরের ধারে পাটি বিছিয়ে বসে কাঠির সঙ্গে বড়শি লাগাচ্ছেন। আজ তাঁর কোনো কাজ নেই। অনেক দিন পর জামাটি ধুয়ে দিয়েছেন। শুকালে সেটি গায়ে চেপে বিলে যাবেন মাছ ধরতে। বিলে আর আগের মতো মাছ নেই। তবে যা পান, তাতে তাঁদের চারজনের তরকারি হয়ে যায়। আমরা যখন কথা বলছিলাম, পলাশ মুর্মুর ডাকে তাঁর সন্তান গোসল সেরে উঠে এল পুকুর থেকে। গা মুছে বাবার পাশে এসে বসল।
মুর্মুর স্ত্রী একটি প্লেটে করে ছেলের জন্য ভাত নিয়ে এল। লাল-সাদা মোটা চালের ভাতের এক পাশে একটু করলা ভর্তা। সুবোধ বালকের মতো ওইটুকু ভর্তা দিয়ে পুরো ভাত খেয়ে নিল। সকালে পান্তা খেয়েছে। বিলে মাছ পেলে রাতে রান্না হবে। গাছের গুড়িতে বসে মুর্মুর স্ত্রী আমাদের কথা শুনছিলেন। তাঁর সঙ্গে খেলছিল তাঁদের ছোট সন্তানটি। জীর্ণ পোশাকে, শীর্ণ শরীরের শিশুটির চেহারায় অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠার স্পষ্ট ছাপ। পুষ্টিকর খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতে মুর্মু জানালেন, যেখানে একবেলা খাবার জোগাতেই হিমশিম, সেখানে পুষ্টিকর খাবার জুটবে কোথায়।
এ রকম চিত্র শুধু পলাশ মুর্মুর নয়, এখানে বসবাসকারী এই পরিযায়ী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবার। অনিল হাসদা, লুইস মুন্ডা সবার। স্থানীয় একজন হাজি তাঁর জমিতে থাকার জায়গা দিয়েছেন। তাঁরা জনজীবনের মূলস্রোত থেকে ছিন্ন। কোনো সামাজিক সুরক্ষা তাঁদের নেই। শৌচাগার নেই, সুপেয় পানির সংস্থান নেই, চিকিৎসা মেলে না। লকডাউনে কিংবা করোনাকালে তাঁরা কোনো সরকারি সাহায্য পাননি। তাঁদের দুর্দশা চরম এবং বর্ণনাতীত। তবে এই হিউম্যান ট্র্যাজেডি নিয়ে খুব বেশি শোরগোল হয় না।
খাদ্যনিরাপত্তা শব্দটি এখানে এসে লজ্জায় মুখ লুকাবে। উন্নয়নের সূচকগুলো এখানে এসে বিষণ্নমনে ফিরে যাবে। মুর্মু জানালেন সরকারি বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে কোনো সহযোগিতা তাঁরা পান না। একবার যোগাযোগ করলে বলেছিল, তাঁরা যেখানকার লোক, সেখান থেকে সহযোগিতা নিতে। এখানে তাঁদের নাম নেই। কনকনে শীতে সন্তানদের নিয়ে চরম ভোগান্তি হয়েছে, কোথাও থেকে শীতের পোশাক কিংবা একটি কম্বল কিছুই পাননি। তবে মুর্মু জানালেন, আশপাশের মানুষ অনেক সহযোগিতা করেন। অনেক সময় তাঁরা খাবার দিয়ে যান, জামাকাপড় দেন।
একটু পরই দেখলাম, আরেকটি শিশু আর্জেন্টিনার জার্সি পরে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, খেলা দেখে কি না, আর্জেন্টিনার সমর্থক কি না। চুপ করে থাকল, কিছুই বলল না। পরে নিজেও লজ্জা পেলাম। যাদের একবেলা খাবার জোটে না। চাঁদ-জোনাকির আলোই যাদের কাছে সম্বল, তারা টিভি দেখবে কোথায়? জার্সি, আর্জেন্টিনা এসব বুঝবে কী করে। মুর্মু জানালেন, কেউ একজন এসে বাচ্চাদের গেঞ্জিগুলো দিয়ে গেছেন কিছুদিন আগে।
ভাবলাম, কোনো আর্জেন্টাইন সমর্থক হয়তো দল জিতুক, এই আশায় দান করেছেন।
মুর্মুরা যেন ভিনগ্রহ থেকে আসা এক এলিয়েন সম্প্রদায়। জাতীয় উন্নয়নের ছোঁয়া তাঁদের জীবনে লাগেনি। মুর্মুসহ এখানকার কেউ করোনার টিকা পাননি। কেউ টিকা নিতেও বলেননি। এমনকি ছোট শিশুটির তিন বছর বয়স হলেও আজ পর্যন্ত কোনো টিকা দেওয়া হয়নি। তাঁদের ক্ষুধা আছে, খাবার নিশ্চয়তা নেই; তাঁদের অসুখ আছে, চিকিৎসা নেই। পাশেই স্কুল আছে, কিন্তু ভর্তির সুযোগ নেই। মুর্মুর ছেলেটির স্কুলে যাওয়ার ভীষণ আগ্রহ। কিন্তু জন্মনিবন্ধন নেই, ভর্তি হতে পারেনি।
মুর্মুর জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। এখানে যোগাযোগ করলে বলেছে, এলাকা থেকে কাগজ আনতে হবে। এলাকায় গেলেও দুই দিন ঘুরেও কাগজ পাননি। এক দিন কাজ না করলে যাঁদের চুলা জ্বলে না, তাঁদের পক্ষে দিনের পর দিন কাগজের পেছনে ছোটার সময় কোথায়। পরে স্কুলে ক্লাসরুমে গিয়ে যখন বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, দেখলাম, জানালার শিক ধরে মুর্মুর ছেলে দাঁড়িয়ে দেখছে। আমি ভেতরে ডাকলে সে গ্রিল ছেড়ে বারান্দা থেকে নেমে গেল। কাগজের ফাঁদে এঁদের জীবন আটকে গেছে। কাগজ নেই বলে শিক্ষা নেই, কাগজ নেই বলে চিকিৎসা নেই, সরকারি কোনো সাহায্য নেই। কাগজের কাছে যেন মানবতা হেরে যায়।
এ রকম চিত্র শুধু পলাশ মুর্মুর নয়, এখানে বসবাসকারী এই পরিযায়ী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবার। অনিল হাসদা, লুইস মুন্ডা সবার। স্থানীয় একজন হাজি তাঁর জমিতে থাকার জায়গা দিয়েছেন। তাঁরা জনজীবনের মূলস্রোত থেকে ছিন্ন। কোনো সামাজিক সুরক্ষা তাঁদের নেই। শৌচাগার নেই, সুপেয় পানির সংস্থান নেই, চিকিৎসা মেলে না। লকডাউনে কিংবা করোনাকালে তাঁরা কোনো সরকারি সাহায্য পাননি। তাঁদের দুর্দশা চরম এবং বর্ণনাতীত। তবে এই হিউম্যান ট্র্যাজেডি নিয়ে খুব বেশি শোরগোল হয় না।
তাঁরা নিজেরাও খুব শান্ত প্রকৃতির। তাঁরা নীরবেই সব কষ্ট নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন হাসিমুখে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে, বাংলাদেশ সংখ্যালঘুদের সব ধরনের বৈষম্য থেকে রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ২০৩০ সাল নাগাদ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গীকার ‘লিভিং নো ওয়ান বিহাইন্ড’ বাস্তবে রূপ দিতে পলাশ মুর্মুদের মতো ‘কেউ যেন বাদ না যায়’, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]