২১ ডিসেম্বর ২০২১, পৌষের পড়ন্ত বিকেল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পশ্চিমপাড়ার শিশুপার্কের একটি স্লাইডের ওপর ছোট ছোট সাদা কাগজের ঠোঙার ভেতর কলি বাদামের ডালি থেকে হাতের মাপে বাদাম ভরাচ্ছে। আর শুভ কাগজে মোড়া একটু লবণ ঢুকিয়ে ঠোঙাগুলোর মুখ ভাঁজ করে সাজিয়ে রাখছে এক এক করে। শুভ আর কলি ভাই-বোন। তাদের একটি ছোট ভাই আছে, নাম জিসান। সেও বাদাম বিক্রি করে। তাদের বয়সী শিশুদের কলকাকলিতে যখন পার্কটি আনন্দে ভরপুর, তখন শুভ-কলি জীবন-জীবিকার খেলায় মশগুল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কলি তার বয়সী শিশুদের সুইং দেখছিল। হয়তো ভাবছিল, তাদের জীবনের গল্পটা আলাদা। ডালি থেকে হাতের মাপে দশ টাকার পরিমাণে বাদাম আলাদা করে ঠোঙায় ভরানোর খেলায় তারা ব্যস্ত। ডালির দুই কেজি ভাজা বাদাম থেকে ষাট থেকে সত্তরটি ঠোঙা করার চ্যালেঞ্জ আছে। ঠোঙা কম হলে লাভ কমে যাবে।
বাদামের দাম আগের চেয়ে বেড়ে গেছে, কিন্তু তাদের প্রতি ঠোঙা বাদামের দাম এখনো ১০ টাকাই আছে, বাড়েনি। লাভে টান পড়লেও বাদামের দাম তারা বাড়ায়নি। ১০ টাকার ঠোঙায় বাদামের পরিমাণেও খুব বেশি হেরফের করেনি। তারা হয়তো এখনো ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেনি, ব্যবসায় নীতি এখনো পড়েনি, তাই হয়তো নৈতিকতাটুকু এখনো আছে।
কাটাখালী বাজার থেকে ২৫০ টাকা দরে ভাজা বাদাম কিনে এনে ফেরি করে ৩০০ টাকায় বিক্রি করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দিনে তিন কেজি বাদাম বিক্রি করতে পারলে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা লাভ হয়। শুভ ও কলি জানে না, কোথায় যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে যে যুদ্ধ চলছে, তার প্রভাব এই বাদাম বিক্রেতা শিশু দুটির জীবিকায় কতখানি প্রভাব ফেলেছে, সে খবর যুদ্ধবাজ রাজারা জানেন না। যেন রাজায় রাজায় যুদ্ধ উলু খাগড়ার প্রাণ যায়।
কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্য প্রায় অস্ত যাওয়ার পথে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ও শীত ঘনিয়ে আসছে। এই শিশু দুটির শরীরে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই। পা দুখানি খালি। জীর্ণ-শীর্ণকায় শিশু দুটির কাঁধে জীবিকার জোয়াল, অনেক দায়-দায়িত্ব। প্রতি সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ টাকার কিস্তি চালাতে তাদের হিমশিম অবস্থা, তার ওপর আবার জিনিসের যা দাম, তাতে পেট চালানোই দায়। মায়ের নেওয়া ঋণের কিস্তি চালাতে আর খাবারের খরচ জোগাতে তিন ভাইবোন মিলে বাদাম বিক্রি করে। তারপরও ধুঁকে ধুঁকে চলছে তাদের সংসার। অনেক দিন স্বামী পরিত্যক্ত থাকার পর তাদের মা আবার নতুন ঘর বেঁধেছে।
শুভ-কলির মা আর ছোট ভাই জিসানের সঙ্গে দেখা করতে তাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাসেল চত্বরে এসেও দেখা মিলল না। জিসান অনেক ছোট বলে তাদের মা তার আশপাশেই থাকে। কখনো দূরে বসে ছেলের বাদাম বিক্রির ওপর চোখ রাখে, কখনো পাতা কুড়ায়, গাছের শুকনা ডাল সংগ্রহ করে। তবে সেখানে তাদের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করে বেড়াচ্ছে।
লাইব্রেরির পেছনের এক চা-দোকান থেকে ফ্লাস্কসহ চা নিয়ে আসে। ওয়ানটাইম কাপে করে চা বিক্রি করে বেড়ায়। প্রতি কাপ চা বিক্রি করলে লাভ হয় এক টাকা। দোকানদার কাপ গুনে দেয় আবার অবশিষ্ট কাপ গুনে টাকার হিসাব করে নেয়। তাদের সবারই ডিসেম্বর মাসে খুব ভালো ব্যবসা হয়েছে। ক্যাম্পাসে এই মাসে প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাইরে থেকে অনেক মানুষ আসে। তারা চা খায়, বাদাম খায়।
২ জানুয়ারি ২০২৩, কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের বিকেল। আজ দুপুরে শুভ কিছু খায়নি। আজ তার মায়ের কিস্তি দেওয়ার তারিখ ছিল। ঘরে কোনো টাকা নেই। চাল কেনা হয়নি, রান্না হয়নি। মা ছোট ভাইকে নিয়ে জুবেরির মাঠে বাদাম বিক্রি করছে। তারা আগে ক্যাম্পাসের অদূরে বিনোদপুরে হানুফার মোড়ে থাকত। রাস্তার পাশে তাদের ঘর ছিল।
রাস্তা প্রশস্ত করার কাজ শুরু হলে তাদের ঘরটি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তারা এখন থাকে শহরের ছোট বনগ্রামের একটি ভাড়া বাসায়। তারা মেট্রোরেলের কথা শোনেনি। সকালে বাসা থেকে বের হয়, রাতে বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে সময় পেলে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখে। করোনার আগে স্কুলে যেত। তারপর আর স্কুলে ফেরা হয়নি। তবে পড়ালেখা আবার শুরু করার ইচ্ছা তার। নতুন বাসা থেকে আসার পথে প্যারামাউন্ট স্কুল পড়ে। সেখানে সে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু কবে কীভাবে ভর্তি হবে, তার জানা নেই। দূর থেকে কেউ একজন ‘এই বাদাম’ বলে ডাক দিতেই শুভ ওদিকে চলে গেল।
তার কাছে উন্নয়ন মানে জ্বালা। উন্নয়ন মানে বুলডোজারে ঘর ভাঙা। উন্নয়ন মানে টাকার দাম নেই, কিন্তু জিনিসপত্রের অনেক দাম। টাকার অভাবে সন্তানের শীতের কাপড় কিনতে পারেনি। ঠিকমতো সন্তানের মুখে খাবার জোগাতে পারছে না। পুরোনো সোয়েটার কিনতে গিয়ে ফিরে এসেছে। এবার পুরোনো কাপড়ের দামও অনেক বেড়েছে।
২ জানুয়ারি ২০২৩। রাত প্রায় আটটা। তীব্র শীত। ক্যাম্পাসের আলো-আঁধারিতে সামনে দিয়ে একটি ছোট শিশু বাদামের ছোট ডালি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। একটু পেছন থেকে একজন নারী তার উদ্দেশে সামনে বড় গাড়ি আসছে বলে তাকে সাবধানে রাস্তা পার হওয়ার জন্য বলছে। তিনি শুভ-কলির মা কি না জানতে চাইলে জানাল, সে তাদের খালা। শিশুটি তারই সন্তান, শুভ-কলির খালাতো ভাই। এই কনকনে শীতে এই ছোট শিশু মুরসালীন বাদাম বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে মুরসালীনকে নিয়ে তিনি বোনের সঙ্গেই থাকেন। জানালেন, তার বোন (শুভ-কলির মা) ঋণ করে রাস্তার পাশে সরকারি জমিতে ঘর বানিয়েছিল। রাস্তা বড় করার সময় সেই ঘর ভেঙে দিয়েছে। মাসে বিদ্যুৎসহ সাড়ে চার হাজার টাকা বাসাভাড়া দিতে হয়। একদিকে কিস্তির টাকা, অন্যদিকে ভাড়া। দুই বোন মিলে হিমশিম খাচ্ছে। ভাড়ার টাকা ঠিকমতো শোধ করতে পারছে না। ভাড়াটাই হয়েছে যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
তার কাছে উন্নয়ন মানে জ্বালা। উন্নয়ন মানে বুলডোজারে ঘর ভাঙা। উন্নয়ন মানে টাকার দাম নেই, কিন্তু জিনিসপত্রের অনেক দাম। টাকার অভাবে সন্তানের শীতের কাপড় কিনতে পারেনি। ঠিকমতো সন্তানের মুখে খাবার জোগাতে পারছে না। পুরোনো সোয়েটার কিনতে গিয়ে ফিরে এসেছে। এবার পুরোনো কাপড়ের দামও অনেক বেড়েছে। চার শ টাকার নিচে কোনো সোয়েটার নেই। মাছ মাসে একবার কিনতে পারে, পারে না। মুরগি শেষ কবে কিনেছে, মনে পড়ে না। ছোট ছেলেটা মাংস খেতে চেয়েছে। চিন্তা করছে মুরগির অর্ধেক মাংস কিনবে। সরকারি কোনো সাহায্য তারা পায় না। ভোটার কার্ড আছে, কিন্তু মা-বাবার কাগজ নেই। কাগজের অভাবে কার্ড পায়নি, টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য পায়নি।
বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে অর্জন করে এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে। দেশ এখন এলডিসির কালিমা থেকে বের হয়ে আসছে। প্রবেশ করেছে মেট্রোরেলের যুগে। কিন্তু এ রকম অসংখ্য শুভ, কলি, জিসান, মুরসালীনের জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। হতদরিদ্র এসব শিশুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। বাড়ছে স্কুলে থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা আর শিশুশ্রমিকদের সংখ্যা। টিসিবির লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা না পাওয়া দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাষ্ট্রের প্রয়োজন এখন সংখ্যাগত উন্নয়নের দিকে বেশি মনোযোগী না হয়ে গুণগত উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দেওয়া। কিন্তু সবাই যেভাবে খেলা নিয়ে ব্যস্ত, উন্নয়নের নামে যে আড়ম্বর, ঠাটবাটের বাহুল্য চলছে, দুর্নীতি-অনিয়ম-লুটপাট যেভাবে বাড়ছে, তাতে এসব মানুষের জীবন-জীবিকা আর জীবন-যন্ত্রণার খেলা দেখার সময় কি রাষ্ট্রের হবে?
ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
Email: faridecoru@yahoo. co. uk