রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে সুস্থ করার কেউ নেই?

মাস তিনেক আগে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ঠিক এমন সময়ে এক বন্ধুর ভাই মুঠোফোনে জানালেন, তিনি মোটরসাইকেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছেন।

তাঁর সঙ্গে যিনি আছেন, তাঁর জ্ঞান নেই। তাঁরা রংপুরের পীরগাছা উপজেলা থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রওনা করেছেন। আমি সব কাজ ফেলে তাঁদের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম।

হাসপাতালে ভর্তিতে নিয়েছে ৫০ টাকা। যদিও কাউন্টারের ওপরে লেখা ভর্তি ২৫ টাকা। একটি ট্রলিতে রোগী ওয়ার্ডে নিয়ে গেল। ট্রলিওয়ালাও ২০০ টাকা নেন। তখন বিকেল চারটা বাজে। বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। ইন্টার্ন চিকিৎসক দীর্ঘ ওষুধের তালিকা দিলেন। আমি নিজে দৌড়ে বাইরে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলাম।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অসাধু ব্যক্তিদের দৌরাত্মে্য অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনেরা। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকও যদি রোগী হন কিংবা রোগীর স্বজন হন, তাঁরাও অসহায় দুর্বৃত্ত চক্রের কাছে। অবস্থা এমন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে

জ্ঞান হারানো রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হলো না। চিকিৎসা করারই সময় পাওয়া গেল না। অনেক টাকার ওষুধ কিনে এনেছিলাম। রোগী আশঙ্কাজনক হওয়ায় আমি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। ওষুধগুলো মিনিট দুয়েকের জন্য ওখানে একজন সেবাদানকারী (!) নিয়েছিলেন।

ওটুকু সময়েই কীভাবে যেন স্যালাইন বাদে সব ওষুধ তছরুপ হয়ে গেল! চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই একজন লোককে নিয়ে এসে উপস্থিত একজন বলছেন, উনি ইসিজি করেছেন। কখন ইসিজি করলেন দেখতেই পেলাম না। ইসিজি বাবদ ৩০০ টাকা নিলেন। একজন ধীরে ধীরে বলছেন, ‘রোগী তো দুর্ঘটনায় মরছে। বের করা কঠিন হবে। আমাদের কিছু টাকা দিলে আমরা বাড়িতে নেওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিতে পারব।’ তঁাদের কথা শুনিনি। বন্ধুর ছোট ভাইয়েরও অ্যাকসিডেন্টে পায়ের অবস্থা খারাপ ছিল। তাঁকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। মৃতদেহ নিয়ে নিচতলায় মরদেহ রাখার ঘরে ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হলো। মৃতদেহ নামানোর পর ট্রলিওয়ালা টাকা দাবি করে বসলেন। একজন সেই টাকাও দিয়েছেন। ততক্ষণে মৃতের স্বজনেরাও এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা যে আরও কত ঘাটে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন, কে জানে!

রক্তাক্ত একজন মানুষ, জ্ঞান নেই—এ অবস্থায় রোগীর সঙ্গে থাকা যে কেউই স্বাভাবিক থাকতে পারবেন না। আমরাও ছিলাম না। তখন কে হাসপাতালের কর্মচারী, কে দালাল কিছুই জিজ্ঞাসা করার অবকাশ ছিল না। ওখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যে প্রত্যেকে প্রতারক চক্র, এটা বুঝতে বাকি ছিল না। সেবাদানে সবচেয়ে কম সক্রিয় ছিলেন চিকৎসক ও নার্সরা।

আরও পড়ুন

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অসাধু ব্যক্তিদের দৌরাত্মে্য অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনেরা। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকও যদি রোগী হন কিংবা রোগীর স্বজন হন, তাঁরাও অসহায় দুর্বৃত্ত চক্রের কাছে। অবস্থা এমন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

অনেকেরই অভিযোগ, সরকারদলীয়দের যোগসাজশে বহাল তবিয়তে আছে হাসপাতালের সিন্ডিকেট। সব সময় সরকার দলীয়দের ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতি এখানে দীর্ঘতর হয়েছে। আজকের এ অবস্থায় আসার নেপথ্যে যে পরিচালকদের তোষণনীতি ছিল না, তা নয়। কোনো পরিচালককে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অসাধুদের মাথায় তুলে রাখায় অবস্থা এমন হয়েছে যে তারা এখন দায়িত্বশীলদের কান ধরে টানছে। এই কান ধরে টানাটানি আর গোপনে নেই, প্রকাশ্যেই টানছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে এই দাঁড়ানো ঢের বিলম্ব হয়েছে। শিকড় এদের অনেক গভীরে। অসাধুদের দুর্বৃত্তায়ন ভেঙে ফেলতে হলে এখন অনেক বড় কাজ করতে হবে। লোকদেখানো দু–চারজন ব্যক্তির বদলি আর সাময়িক বরখাস্ত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে সুস্থ করে তুলতে পারবে না।

হাসপাতালে কেউ-ই শখ করে যান না। খুব না ঠেকলে কেউ অন্তত সরকারি হাসপাতালের দিকে মুখ করেন না। যখন রোগী ভর্তি করাতে যান, তখন রোগীর সঙ্গে থাকা মানুষের মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না। এমন অবস্থায় তঁাদের বিপদে ফেলে পদে পদে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতো জঘন্য কাজ চলে এ হাসপাতালে।

সম্প্রতি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসকের মায়ের চিকিৎসার সময়ও এসব দালাল ছাড় দেয়নি। তিনি লিখিত অভিযোগ করলে হাসপাতালের পরিচালক দুজন কর্মচারীকে বরখাস্ত করেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটিতে সম্মিলিত চিকিৎসক সমাজ একটি মানববন্ধন করে। ব্যানারে লেখা ছিল ‘অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য, অব্যবস্থাপনা ও জনদুর্ভোগের প্রতিবাদে মানববন্ধন।’

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ মানববন্ধন ইতিহাস হয়ে থাকবে। যাঁরা হাসপাতালের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করবেন, দৌরাত্ম্য বন্ধ করবেন, জনদুর্ভোগ বন্ধ করবেন, তাঁরাই মানববন্ধন করেছেন।

তার মানে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কতটা ভয়াবহ হলে চিকিৎসকেরাও এমন নিরুপায় হন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ মানববন্ধনকে আমলে নিয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১৬ জন কর্মচারীকে, ২ অক্টোবর উপপরিচালক, সহকারী পরিচাললকসহ ৩ কর্মকর্তাকে বদলি করেছে। উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালকেরা চিকিৎসক। তাহলে শুধু যে অসাধু কর্মচারীর দৌরাত্ম্য নয়, এর নেপথ্যে কর্তাব্যক্তিরাও আছেন, তা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

আমরা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুস্থতা চাই। যেকোনো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও যেন গিয়ে সঠিক সেবা পায়, সেটা আমাদের প্রত্যাশা। আমরা জানি, সরকারি হাসপাতাল ভালো চললে প্রাইভেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের জন্য তা সুখের হবে না। সরকারি হাসপাতালকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে এসব ব্যবসায়ী চিকিৎসকের হাত আছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।

দেশে কি এমন একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে পাওয়া যাবে না, যিনি উদ্যোগ নিয়ে এ হাসপাতালকে সুস্থ করে তুলবেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, রংপুরের যেকোনো মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, মেয়রসহ এমন কি কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে পারেন?

বদলি, সাময়িক বরখাস্ত করে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিত করা যাবে না। আমরা অপেক্ষায় আছি, কেউ না কেউ রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ ফিরিয়ে আনবেন।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।

[email protected]