বাংলা ভাষায় প্রযুক্তি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চাহিদা বুঝবে কবে

অনলাইনে অন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহিন আলম। ঝিনাইদহের মহেশপুরে।ছবি: প্রথম আলো

আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। দিবসটি ঘিরে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সচেতনতামূলক পোস্টে সয়লাব, ঠিক সেই সকালেই স্মার্টফোন হাতে নিয়ে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রিফাতের (ছদ্মনাম) দিনটা রয়ে যায় মলিন।

এই দিনটির অর্থ রিফাতের জন্য আলাদা। প্রতিবন্ধিতার পরিসংখ্যানের তালিকায় সে শুধু একটি সংখ্যা নয়; সে রক্তমাংসের একজন মানুষ, যার প্রতিটি দিনই প্রযুক্তির সঙ্গে এক নীরব সংগ্রাম।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রিফাতের দিনও শুরু হয়। চোখে আলো নেই, তবু এক অদ্ভুত সুর যেন তার পৃথিবীর দরজা খুলে দেয়। সেই দরজাটি ‘বাংলা টেক্সট-টু-স্পিচ অ্যাপ’। সেই অ্যাপের কল্যাণে চোখ নয়, শ্রবণই এখন রিফাতের দৃষ্টি। সেই অ্যাপের মাধ্যমেই নানান মাধ্যমে প্রকাশিত লেখাগুলোর প্রতিটি শব্দ শুনেই শুরু হয় তার প্রতিদিনের পথচলা।

সেই অ্যাপে কিছু শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসে, আবার কিছু শব্দ স্পিকারের গহিনে বেঁকে যাওয়া লোহার মতো খটখটে শোনায়। তবু রিফাত থেমে থাকে না, কারণ এ পৃথিবী তাকে থামিয়ে দেওয়ার অনেক কারণ দিলেও, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা সে নিজেই হয়ে উঠেছে।

রিফাতের এই অভিজ্ঞতা অনন্য নয়। দেশের হাজারো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির দিন শুরুই হয় ত্রুটিপূর্ণ স্ক্রিন রিডার, ভুল উচ্চারণ, অপাঠ্য পিডিএফ আর অ্যাক্সেসিবিলিটি (প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রযুক্তি সহজীকরণ সেবা)-বিমুখ ওয়েবসাইটের সঙ্গে লড়াই করে।

ঢাকার অন্য প্রান্তে ঠিক একই সকালে অনলাইন ক্লাসে যোগ দেয় মিতু। দৃষ্টিশক্তি কম হলেও স্বপ্নে আলো কম নেই তার। সহপাঠীরা নির্বিঘ্নে পড়তে পারলেও মিতুকে (ছদ্মনাম) বারবার স্ক্রিন বড় করতে হয়। কিন্তু স্ক্রিন একটু বড় করলে অনলাইন পেজের বিন্যাসই হারিয়ে যায়। স্ক্রিন রিডার ব্যবহার করতে গেলে উচ্চারণ যেন আরেক বিপত্তি। সেখানে ‘বাংলাদেশের সংবিধান সমতা নিশ্চিত করে’ বাক্যটি ইংরেজিতে উচ্চারিত হয় ‘বাংলাদেশ কনস্টিটিউশন গ্যারান্টি কোয়ালিটি’ হিসেবে। যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বাংলাদেশের সংবিধান মান নিশ্চিত করে’।

মিতুর চোখের সামনে অক্ষরগুলো বেঁকে গেলেও সবচেয়ে বেশি বেঁকে যায় বোঝার সেতুটা। অর্থের সঙ্গে বোঝাপড়ার দূরত্ব তখন আরও বাড়ে। বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষ রিফাত বা মিতুর মতো নিয়মিত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ভাষা, প্রযুক্তি আর অ্যাক্সেসিবিলিটির ফাঁকফোকরের মাঝখানে।

একদিকে প্রযুক্তির অগ্রগতি, অন্যদিকে তার অসামঞ্জস্যতা। স্ক্রিন রিডার আছে, ম্যাগনিফায়ার আছে, বাংলা ওসিআর আছে, কিন্তু অধিকাংশই ব্যবহার উপযোগী নয়। কোথাও ভুল উচ্চারণ, কোথাও স্থানীয়করণের ঘাটতি, কোথাও প্রশিক্ষণহীনতা। গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে উন্নত বাংলা প্রযুক্তি আছে, কিন্তু সেগুলো যেন কাচের আলমারিতে আটকে থাকা প্রদর্শনীর জন্য। মানুষের বাস্তব জীবনে তা পৌঁছায় না।

এদিকে সরকারি ওয়েবসাইটগুলো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানে অ্যাক্সেসিবিলিটির অভাবে ই-সেবা যেন অদৃশ্য দেয়ালে আটকে থাকে। সরকারি অনেক পিডিএফ ফাইল স্ক্রিন রিডারে ‘অপাঠ্য’। মোবাইল অ্যাপের বড় অংশেই ‘টেক্সট টু স্পিচ’ বা লেখাকে উচ্চারণ করার প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নেই।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতায় আমি এখানে তিনটি বড় বাধা আছে বলে মনে করি। প্রথমত, ডেটা ঘাটতি—প্রতিবন্ধী মানুষের প্রযুক্তিগত চাহিদা সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য নেই। দ্বিতীয়ত, সেবার ঘাটতি—সহায়ক প্রযুক্তিকে ডিভাইস হিসেবে দেখা হয়, ইকোসিস্টেম হিসেবে নয়। তৃতীয়ত, স্থানিকরণের ঘাটতি—বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অ্যাক্সেসিবল প্রযুক্তি অনুবাদনির্ভর, মাতৃভাষাভিত্তিক নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, দেশে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার। ইউনিসেফের তথ্য মতে, অর্ধেকের বেশি প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে যেতে পারে না। কারণ, পাঠ্যবই, ক্লাসরুম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তাদের জন্য মানানসই নয়। এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়, এগুলো রিফাতদের শিক্ষা, মিতুদের চাকরি, হাজারো মানুষের স্বপ্নের হিসাব, যা হাজারো ভবিষ্যতের দিগন্ত নির্ধারণ করে।

যদিও বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নীতিপর্যায়ে অনেক অগ্রগতি করেছে। দেশে অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩, ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি নীতি আছে। কিন্তু নীতি যদি প্রয়োগে না আসে, তাহলে তা তালাবদ্ধ দরজার মতো।

এদিকে বাংলা ভাষা প্রযুক্তি দ্রুত উন্নত হচ্ছে। উন্নত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক টিটিএস, বাংলা ওসিআর, স্পিচ-টু-টেক্সট। এই যাত্রায় ‘এটুআই’ প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এটুআই-এর ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি অডিট, অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজাইন প্রশিক্ষণ, স্থানীয় মানদণ্ড গঠন, ডেভেলপার প্রশিক্ষণ—এসব উদ্যোগ ডিজিটাল রূপান্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সৃষ্টি করেছে। নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরিতে এটুআই এখন একটি জাতীয় রেফারেন্স মডেল। তবু পথ অনেক বাকি।

আরও পড়ুন

গবেষণা থেকে মূলধারায় আসার যাত্রা এখনো ধীর। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল বা সরকারি সেবায় এগুলোর প্রয়োগ খুব কমই দেখা যায়।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতায় আমি এখানে তিনটি বড় বাধা আছে বলে মনে করি। প্রথমত, ডেটা ঘাটতি—প্রতিবন্ধী মানুষের প্রযুক্তিগত চাহিদা সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য নেই। দ্বিতীয়ত, সেবার ঘাটতি—সহায়ক প্রযুক্তিকে ডিভাইস হিসেবে দেখা হয়, ইকোসিস্টেম হিসেবে নয়। তৃতীয়ত, স্থানিকরণের ঘাটতি—বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অ্যাক্সেসিবল প্রযুক্তি অনুবাদনির্ভর, মাতৃভাষাভিত্তিক নয়।

এসব সংকট সমাধানের জন্য পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করি। ১. প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক ও প্রযুক্তিগত ডেটা জাতীয় জরিপে অন্তর্ভুক্তি। ২. ডিভাইসের পাশাপাশি নিয়মিত প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা ও সাপোর্ট চেইন শক্তিশালীকরণ। ৩. বাংলা ভাষাভিত্তিক টিটিএস, স্ক্রিন রিডার ও ওসিআরে বিনিয়োগ। ৪. লো-ভিশন সাপোর্টকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সরকারি সেবায় মূলধারায় অন্তর্ভুক্তি। ৫. ওপিডি, নেতৃত্বাধীন কমিউনিটিভিত্তিক পাইলট শুরু করা।

শেষ পর্যন্ত রিফাতের স্ক্রিন রিডার আর মিতুর ম্যাগনিফায়ার আমাদের শেখায়, প্রযুক্তি ক্ষমতায়ন দিতে পারে, যদি তা মানুষের ভাষা বোঝে, অনুভূতি বোঝে, আর যদি তা অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিতে নির্মাণ করা হয়।

প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে আমরা সমতার কথা বলি। অধিকার, মর্যাদা, সুযোগ—সবই উঠে আসে আলোচনায়। কিন্তু রিফাত-মিতুদের প্রশ্ন একটাই—‘আমাদের ভাষায় প্রযুক্তি যখন কথা বলবে, তখনই কি আমরা সত্যিকারের সমান হব?’

বাংলাদেশের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি কোনো বিলাসিতা নয়, এটি ন্যায়ের পরবর্তী অধ্যায়। এখন সময় বাংলায় অ্যাক্সেসিবল প্রযুক্তিকে প্রান্তিক প্রকল্প নয় বরং মূলধারার জাতীয় অগ্রাধিকার বানানোর। তবেই আধখোলা দরজার পৃথিবী পুরোপুরি খুলে যাবে, যেখানে রিফাত বা মিতুর মতো হাজারো মানুষ দেখতে পাবে নিজেদের ভবিষ্যতের আলো।

  • ভাস্কর ভট্টাচার্য্য ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি বিশেষজ্ঞ ও প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী

*মতামত লেখকের নিজস্ব