মাসের পর মাস ধরে ইসরায়েল ও তাদের সমর্থকেরা বলে এসেছে, হামাস নাকি গাজায় পাঠানো মানবিক ত্রাণ সহায়তা চুরি করছে। এ অজুহাত দেখিয়ে তারা গাজার ২০ লাখ মানুষকে না খাইয়ে রেখেছে; তারা খাবারের দোকান ও বেকারিতে বোমা ফেলেছে, খাদ্যবাহী ট্রাক আটকে দিয়েছে, এমনকি রুটি নিতে লাইনে দাঁড়ানো হতাশ ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালিয়েছে। তারা বলেছে, এটি নাকি হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ; সাধারণ মানুষ নাকি কেবল মাঝখানে পড়ে গেছে।
কিন্তু এখন আমরা আসল সত্যটা জানতে পেরেছি। আমরা জানতে পেরেছি, ইসরায়েল গাজায় এমন অপরাধী গুন্ডা বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এবং তাদের সেখানে মোতায়েন করে রেখেছে।
এই ভাড়াটে অস্ত্রধারীরা মানবিক সাহায্য লুট করে আর সাধারণ মানুষকে ভয় দেখায়। এ ধরনের একটি গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়াসের আবু শাবাব নামের একজন ব্যক্তি। আবু শাবাবের সঙ্গে উগ্রপন্থী নেটওয়ার্কের যোগসূত্র আছে এবং তিনি নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এই গ্যাং সরাসরি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের কাছ থেকে অস্ত্র পাচ্ছে।
নেতানিয়াহু এ নিয়ে লুকোছাপা করছেন না। তিনি বরং গর্ব করে বলছেন, ‘এতে সমস্যা কী? এতে তো আমাদের সেনাদের জীবন বেঁচে যায়।’
সমস্যা কী? সমস্যা সবকিছুতেই।
এটা শুধু কৌশলগত কোনো সিদ্ধান্ত নয়, এটা আসলে তাদের আসল উদ্দেশ্যর স্বীকারোক্তি। ইসরায়েল কোনো দিনই ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা দিতে চায়নি। তারা ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভেঙে দিতে চায়। তারা তাদের না খাইয়ে মেরে ফেলতে চায়। তারা ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভেতরেই একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চায়। এরপর সেই বিশৃঙ্খলা ও কষ্টের দায়ও আবার তাদের ওপরই চাপিয়ে দিতে চায়।
দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা করে আসছে, যাতে ফিলিস্তিনিদের কোনো ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়ে না ওঠে। ১৯৮০-এর দশকে তারা আড়ালে–আবডালে ধর্মীয় ও সামাজিক শক্তি হিসেবে হামাসের উত্থানকে উৎসাহিত করেছিল, যাতে হামাস ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তি সংগঠন পিএলওর একটি পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়ায়।
এ পদ্ধতি নতুন কিছু নয়। এটি উপনিবেশবাদের পুরোনো কৌশল: আগে বিশৃঙ্খলা তৈরি করো, তারপর সেটাকেই প্রমাণ হিসেবে দেখাও যে এই মানুষগুলো নিজেদের শাসন করতে পারে না। গাজায় ইসরায়েল শুধু হামাসকে হারাতে চায় না, তারা গাজার এমন ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিতে চায়, যেখানে ফিলিস্তিনিরা নিজেরা নিজেদের সমাজ চালাতে পারবে।
মাসের পর মাস পশ্চিমা গণমাধ্যম হামাসের ত্রাণ চুরির অভিযোগ সামনে আনলেও তারা কখনো কোনো প্রমাণ দেখায়নি। জাতিসংঘ বারবার বলেছে, এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু তাতে কিছু যায়–আসে না। ওই গল্পটাই কাজ করেছে। গল্প দিয়েই তারা অবরোধকে ন্যায্যতা দিয়েছে। মানুষকে না খাইয়ে মারাকে তারা নিরাপত্তাকৌশল হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
তবে ইসরায়েলের মিথ্যাটা ভেঙে পড়েছে। এরপরও কোথায় ক্ষোভ? কোথায় ইসরায়েলবিরোধী প্রতিবাদ? কোথায় যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের কড়া বিবৃতি?
নেতানিয়াহুর প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি শুধুই ঔদ্ধত্য নয়, এটি আত্মবিশ্বাসেরও প্রকাশ। তিনি জানেন, তিনি এখন লুকোছাপা করা কথা চেঁচিয়ে বললেও কিছু হবে না। তিনি জানেন, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভাঙলে গুন্ডাদের অস্ত্র দিলে, স্কুলে বোমা মারলে, এমনকি সাধারণ মানুষকে না খাইয়ে রাখলেও বিশ্বমঞ্চে তাঁদের স্বাগত জানানো হবে। তিনি জানেন, এত কিছুর পরও তাঁদের ‘মিত্র’ বলে প্রশংসা করা হবে।
এটাই হচ্ছে দায়মুক্তির চূড়ান্ত রূপ—যেখানে কেউ কিছু বলবে না, কোনো অপরাধের সাজা হবে না।
আজকের এই পরিণাম এসেছে ইসরায়েলের সেই সব প্রচারযন্ত্রকে বিশ্বাস করার কারণে, যারা ইসরায়েলকে অনিচ্ছাকৃত দখলদার হিসেবে দেখিয়ে এসেছে, ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে ‘মানবিক’ ও পরিস্থিতির শিকার হওয়া বাহিনী হিসেবে দেখিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ইসরায়েল এমন এক শাসনব্যবস্থা, যা যুদ্ধাপরাধকে শুধু অনুমোদনই দেয় না; বরং তারা যুদ্ধাপরাধের পরিকল্পনা করে, অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, এরপর সেই অপরাধকেই নিজের পক্ষে প্রচারণা হিসেবে ব্যবহার করে।
দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা করে আসছে, যাতে ফিলিস্তিনিদের কোনো ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়ে না ওঠে। ১৯৮০-এর দশকে তারা আড়ালে–আবডালে ধর্মীয় ও সামাজিক শক্তি হিসেবে হামাসের উত্থানকে উৎসাহিত করেছিল, যাতে হামাস ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তি সংগঠন পিএলওর একটি পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়ায়।
এ কৌশলের মোক্ষ ছিল—ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে ভাঙো, জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করো, আর স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যেকোনো চেষ্টাকে খণ্ডিত করে দাও।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বিশ্বাস করতেন, পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে উৎসাহ দিলে ফিলিস্তিনি জনগণের ভেতরেই দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। আর সেটাই হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। ফল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ফিলিস্তিনিদের সংঘাত বেড়েছে। রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব বেড়েছে।
এই কৌশল শুধু গাজায় নয়, পশ্চিম তীরেও এখনো চলছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) কার্যক্ষমতা ধ্বংস করতে যে কর–রাজস্ব আটকে রাখছে, তা পিএর বাজেটের বড় অংশ। এতে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মুখে আছে।
পশ্চিম তীরে মূল ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের ওপর প্রায়ই ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা হামলা চালায়। ইসরায়েলি সেনারা প্রতিদিন পশ্চিম তীরের শহরগুলোয় অভিযান চালায়। তারা পিএর নিরাপত্তা বাহিনীকে অপমান করে। একই রকম কৌশল চলে ইসরায়েলের ভেতরেও। সেখানে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়। তাদের এলাকায় অপরাধ বাড়তে দেওয়া হয়। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোয় অর্থ ছাড়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়।
এভাবে ইসরায়েল একদিকে ফিলিস্তিনিদের অস্থিতিশীল করে তোলে, আর পরে সেই বিশৃঙ্খলাকেই দেখিয়ে বলে, ‘তারা নিজেরা নিজেদের চালাতে পারে না, তাই আমাদের দরকার।’
এটা শুধু নৃশংসতা নয়, এটা অত্যন্ত হিসাব-নিকাশ করে করা কৌশল।
আহমেদ নাজার ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাট্যকার
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ