ইউরোপ আর কবে নিরাপত্তায় স্বনির্ভর হবে

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন খুব বেশি আশা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছেছবি: রয়টার্স

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিরা নিরাপত্তা সহযোগিতা ইস্যুতে যখন নিজেদের মত দিচ্ছিলেন, তখন তাঁদের মধ্যে একজন দীর্ঘশ্বাস মেশানো কণ্ঠে বললেন, ‘শুধু কথা, কথা আর কথা!’ অর্থাৎ, ইউরোপের নিরাপত্তার ব্যাপারে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সম্মেলন থেকে যে বার্তা দেওয়া হচ্ছিল, সে বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করে আরেক আলোচক বললেন, নিরাপত্তা নিয়ে ইউরোপের গা ছাড়া ভাব দেখে চীন এখন সম্ভবত ভাবছে, ‘ইউরোপ নিয়ে আমাদের আর চিন্তার কিছু নেই।’

গত সপ্তাহান্তে অনুষ্ঠিত ইউরোপের নীতিনির্ধারক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের এই সমাবেশে একটা প্রচ্ছন্ন বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। সেখানে নেতাদের আলোচনায় মনে হয়েছে, তাঁরা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর গভীরতর হওয়া এবং সংকট আরও জটিল হওয়া নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। অনেককে ক্লান্ত এবং হতাশাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছিল। এর মধ্যেই ইউক্রেনের আভদিভকা শহরের পতন ঘটতে যাচ্ছে বলে খবর এসেছে।

ইউক্রেনের গোলাবারুদের উৎস একেবারে কমে এসেছে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর চলতি মেয়াদে কংগ্রেস থেকে ইউক্রেনের জন্য আরেকটি সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করিয়ে আনতে পারবেন কি না, তা কেউ বলতে পারছে না। অন্যদিকে রাশিয়ায় কারারুদ্ধ অবস্থায় সে দেশের বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি মারা যাওয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের একনায়কোচিত নৃশংসতা আরেক দফা সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি সবাইকে সবচেয়ে ভাবিয়ে তুলেছে, সেটি হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা। কারণ, ট্রাম্প গদিতে ফিরলে নিশ্চিতভাবে তাঁর প্রত্যাবর্তন ইউক্রেনকে দুর্বল করে দেবে এবং চীনের সঙ্গে ইউরোপের উত্তেজনা বাড়বে। সব মিলিয়ে ইউরোপের জন্য সময়টা এখন খারাপ। একদিকে রাশিয়া মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র পাঠানোর চেষ্টা করছে বলে খবর বের হচ্ছে, অন্যদিকে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট এখন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।

আরও পড়ুন

মিউনিখ সম্মেলনের মঞ্চে যে আলোচনা–পর্যালোচনা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ছিল ইউরোপের মিত্রদের আশ্বস্ত করা কথাবার্তা (যা প্রতিবছরই হয়ে থাকে)। তবে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, ইউরোপীয়দের নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ শুরু করা উচিত।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইউরোপ মহাদেশে একটি বড় স্থলযুদ্ধ চলছে; মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের হুমকি রয়েছে; পশ্চিম বলকানে নাজুক অবস্থা বেড়ে গেছে এবং ইউরোপীয় সমাজের গভীরে ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ বেড়ে গেছে; তারপরও ইউরোপের সরকারগুলো নিজেদের নিরাপত্তা ইস্যুতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সম্মেলনে এই বিষয় মনে করিয়ে দিয়ে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ যথার্থই বলেছেন, ‘নিরাপত্তা না থাকলে সবকিছুই অসার হয়ে যায়।’

ইউরোপ যদি প্রতিরক্ষা ইস্যুতে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ না করে, তাহলে ২০২৪ সালকে সেই বছর হিসাবে স্মরণ করতে হবে, যে বছরে ইউক্রেনকে পরিত্যক্ত করা হয়েছিল, যে বছরে ট্রান্স আটলান্টিক জোট ভেঙে গিয়েছিল; যে বছরে ইউরোপ ও বাকি বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি নেমে এসেছিল।

মাত্র এক বছর আগের পরিস্থিতি এখনকার তুলনায় অনেক ভালো ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পা দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও তাঁর সহযোদ্ধারা যে সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো ইউক্রেনীয়দের সমর্থনে এক হয়েছিল।

আশা ছিল, ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে নতুন উদ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু এখন সেই উদ্যম অনেকটা দমে গেছে এবং ইউরোপের কৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলো বহুগুণ বেড়ে গেছে।

এখন অধিকতর দৃঢ় ও আগ্রাসী চীনকে বাগে রাখতে ইউরোপকে তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে, ন্যাটোর বাইরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে এবং নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য ইউরোপীয় নেতাদের জরুরি ভিত্তিতে একটি বিশদ পরিকল্পনা দরকার।

ইউরোপিয়ান কমিশনের কর্মকর্তারা এবং ইইউর ছোট সদস্যরাষ্ট্রগুলোর (যেমন বাল্টিক অঞ্চলের) নেতারা একটি দৃঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে মিউনিখে এসেছিলেন। তবে সম্মেলনে যোগ দেওয়া অন্য অনেকেই তাঁদের সেই উদ্দেশ্যের বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। লক্ষণীয়ভাবে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এবং পোল্যান্ডের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টুস্ক দেশে ছিলেন। তাঁরা সম্মেলনে যাননি।

এই দুই নেতা যদি সম্মেলনে যোগ দিতেন এবং ইইউর বৃহত্তম প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়কারী ও ইউক্রেন সমর্থক হিসেবে তাঁদের নিয়ে ওলাফ শলৎজ সম্মেলনের এক ফাঁকে একটি ‘ভাইমার ট্রায়াঙ্গেল’ বৈঠকে বসতে পারতেন, তাহলে সেটি রাশিয়া ও চীনকে একটি কড়া বার্তা দিতে পারত।

এদিক থেকে অবশ্য জার্মানি অনেকটা এগিয়েই রয়েছে। ন্যাটো প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা (জিডিপির ২ শতাংশ) পূরণে ১০ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠনের পাশাপাশি এই দেশ ইউক্রেনকে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে। ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলকে শক্তিশালী করতে এই দেশই প্রথম লিথুয়ানিয়ায় স্থায়ী যুদ্ধসেনা পাঠিয়েছে।

এসব পদক্ষেপ একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারে। যথার্থ নেতৃত্ব থাকলে সেই ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে বাকি কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়।

কিন্তু নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের সামগ্রিক অভাব সাম্প্রতিক কিছু সুসংবাদকে প্রায় কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে। মিউনিখ সম্মেলনের ঠিক আগে ইউক্রেন যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের সঙ্গে নতুন দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এটিকে আরেকটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সুযোগ বলা যায়।

ইউরোপীয় নেতারা যদি ইউরোপের নিরাপত্তার বিষয়ে আন্তরিক থাকেন, তাহলে তা দেখানোর পরবর্তী সুযোগ হবে আগামী জুলাইয়ে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে। ইউরোপ যদি প্রতিরক্ষা ইস্যুতে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ না করে, তাহলে ২০২৪ সালকে সেই বছর হিসাবে স্মরণ করতে হবে, যে বছরে ইউক্রেনকে পরিত্যক্ত করা হয়েছিল, যে বছরে ট্রান্স আটলান্টিক জোট ভেঙে গিয়েছিল; যে বছরে ইউরোপ ও বাকি বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি নেমে এসেছিল।

● ড্যানিয়েলা শোয়ার্জার জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সাবেক পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত