বাংলাদেশের সম্প্রতি একজন তরুণ রাজনীতিবিদ গুলির শিকার হয়েছেন। এর ফলে নতুন করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিশেষ করে আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা, অবৈধ ব্যবহার এবং জনমনে যে একধরনের অনিরাপত্তার অনুভূতির প্রশ্নটি সামনে এসেছে, এর বিপরীতে একজন উপদেষ্টা বলেছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যাঁরা সংসদ সদস্যপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করার লাইসেন্স দেওয়া হবে—জাতীয় জীবনে এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই নীতিমালার সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে এবং বিশ্বব্যাপী গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন তরুণ রাজনীতিবিদ ভয়ংকর আগ্নেয়াস্ত্র হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। এর ফলে নতুন করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিশেষ করে আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা, অবৈধ ব্যবহার এবং জনমনে অনিরাপত্তার অনুভূতি আরও তীব্র হচ্ছে; কিন্তু চলমান সমস্যার সমাধানে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করছেন, তাতে সমস্যার সমাধান না হয়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
আলোচ্য বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলার আগেই বলে রাখা উচিত যে এই হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। হামলাকারী যে–ই হোক না কেন, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলা অত্যন্ত জরুরি— দুর্ঘটনা, হামলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তদন্তের আগেই রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি কিংবা যে কারও দিকেই আঙুল তোলা কিংবা দোষী সাব্যস্ত করা আইনি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে।
বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরেই ছিল; কিন্তু আমরা চাই, সামনের দিনগুলোতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এ–জাতীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন। তাঁদের কাছে যদি গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো তথ্য থাকে, তাঁরা সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলবেন; কিন্তু জনসমক্ষে এসব নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আগ্নেয়াস্ত্র হামলার পরিপ্রেক্ষিতে একজন উপদেষ্টা বলেছেন যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যাঁরা সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার লাইসেন্স দেওয়া হবে। জাতীয় জীবনে এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই নীতিমালার সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে এবং বিশ্বব্যাপী গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি।
ইউরোপের অন্য অনেক দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। ২০২৩ সালের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে প্রতিবছর প্রায় অর্ধলক্ষের মতো মানুষের মৃত্যু হয় গুলিতে—ম্যাস শুটিং, আত্মহত্যা, পারিবারিক কলহ—এসব ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়।
সম্প্রতি কয়েকটি বিষয়ে বিবেচনা করলে বেশ কিছু আশঙ্কার চিত্র আমাদের সামনে উঠে আসে। বিশেষত, গত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে হাজার হাজার আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ইত্যাদি লুট হয়ে যায়। এসব আগ্নেয়াস্ত্র আজ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়নি এবং কাদের কাছে এই অস্ত্রগুলো রয়েছে, তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে এসব আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার আমরা দেখেছি, যেটা রীতিমতো আশঙ্কার।
দ্বিতীয়ত, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন উপদেষ্টা এর আগে বলেছিলেন যে বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে অন্যান্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। তরুণ সমাজকে শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধুলা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি; কিন্তু ঠিক কী কারণে তরুণ সমাজকে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে এবং কতখানি ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। যাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন যে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ দেশের নিরাপত্তার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রশিক্ষণের পরে তাঁরা কী করবেন, এটি তীব্র মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
তৃতীয়ত, অন্য একজন উপদেষ্টা অস্ত্র হামলার বিপরীতে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের জন্য অস্ত্র পাওয়া সহজ করে দিচ্ছেন। এ তিনটি বিষয় একসঙ্গে বিবেচনা করলে এটি পরিষ্কার যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে অর্থাৎ অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার বিপরীতে আমাদের সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং নীতিনির্ধারকেরা আগ্নেয়াস্ত্র আরও বেশি সহজলভ্য করে এই সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ কিনা গোলাগুলির সমস্যা আরও অধিক গোলাগুলির সম্ভাবনা দিয়ে তাঁরা সমাধান করতে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতের বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য কতখানি অশনিসংকেত, সেটা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কয়েকটি উদাহরণ বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া সহজ, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। কেবল ‘ম্যাস শুটিং’ নয়, আত্মহত্যা, পারিবারিক হত্যাকাণ্ড এবং প্রতিদিনের সহিংসতায়ও মৃত্যু বেশি হয়। যুক্তরাষ্ট্র এদিক থেকে স্পষ্ট উদাহরণ।
ইউরোপের অন্য অনেক দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। ২০২৩ সালের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে প্রতিবছর প্রায় অর্ধলক্ষের মতো মানুষের মৃত্যু হয় গুলিতে—ম্যাস শুটিং, আত্মহত্যা, পারিবারিক কলহ—এসব ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়। আমাদের মনে রাখা উচিত, এগুলো নিছক সংখ্যা নয়, প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত আছে একটি পরিবার, মা–বাবা, সন্তান, জীবনসঙ্গী। শুধু তা–ই নয়, এসবের প্রতিক্রিয়ায় আরও প্রতিহিংসামূলক মৃত্যু ও হত্যাকাণ্ড অসম্ভব নয়।
কিছু তুলনামূলক তথ্য দেওয়া যাক—সম্প্রতি কমনওয়েলথ ফান্ডের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর হার পৃথিবীর অনেক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মৃত্যুর হারের তুলনীয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর হার যুদ্ধবিধ্বস্ত হাইতির চেয়ে দ্বিগুণ। যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডে আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে মৃত্যুর হার যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ সেই মৃত্যুর হার যুক্তরাজ্যের মৃত্যুর হারের তুলনায় ২৩ গুণ বেশি। কারণ, যুক্তরাজ্যে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন।
অস্ট্রেলিয়ায় একসময় আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া সহজ ছিল। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু করলে অস্ট্রেলিয়া কঠোর নীতি গ্রহণ করে, যাতে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এরই ফলে দেখা গেল, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে।
শুধু সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র সহজলভ্য করলে সেটি সমালোচিত হতে বাধ্য। প্রথমত, বিপুলসংখ্যক সংসদ সদস্য প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে ধারণা করা যায়। দ্বিতীয়ত, সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে এমন বিশেষ কোনো নজরদারি কিংবা শর্ত আরোপ করা হয় না, যা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি কমাবে।
তৃতীয়ত, প্রশ্ন আসবে, শুধু সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রেই কেন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা সহজ করা হবে, সমাজের অন্যান্য মানুষের জন্য কেন নয়? এবং কোন জায়গায় এই তালিকা বন্ধ হবে? সব মিলিয়ে এই সংকট মুহূর্তে সমাজে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা বেড়ে গেলে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা যায়। ভবিষ্যতে আরও বেশি মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে ইচ্ছুক হলে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বেশি বেশি অস্ত্র পাচার করতে উদ্বুদ্ধ হবে।
বিভিন্ন উপদেষ্টা এবং নীতিনির্ধারকেরা যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন, তাতে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে খোঁজ নেওয়া দরকার বৈশ্বিক কোনো আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে কোনো লবি করছে কি না।
গোলাগুলোর সমাধান—গোলাগুলি কিংবা গালাগালি নয়, গলাগলি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। কিন্তু সেটি সম্ভব করতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ ও সংস্কার প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয় তিনটি—১. লুট হয়ে যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, ২. লুট হয়ে যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, ৩. লুট হয়ে যাওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার।
ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম সহযোগী অধ্যাপক, রিসার্চ এডিটর, ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল
*মতামত লেখকের নিজস্ব