প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা এবং পুরোনো রাজনীতির নতুন পোশাক

তদন্তের জন্য প্রথম আলো কার্যালয় ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারওয়ানবাজার, ঢাকা, ২০ ডিসেম্বরছবি: খালেদ সরকার

গত বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫) রাতে একের পর এক অনেক ঘটনা ঘটেছে। একদল উগ্রপন্থী দেশের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা অফিস, প্রথম আলো আর দ্য ডেইলি স্টার ভবনে হামলা করছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এরপর তারা চলে গেছে দেশের স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের দিকে। এরপর উদীচী। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় হিন্দু ধর্মের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর ওই যুবকের মরদেহ গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন দেওয়া হয়েছে। একজন সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যিনি খুলনায় এক প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন।

নানা জায়গায় ভাঙচুর ও হামলা হয়েছে। ফেসবুকে একের পর এক ভিডিও ঘুরছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে সিনিয়র সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর হামলা হচ্ছে, কোনো ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ। ডেইলি স্টার–এর এক তরুণী সাংবাদিক ফেসবুকে লিখলেন, ধোঁয়ায় তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। ৩০ জনের বেশি সাংবাদিক ডেইলি স্টার ভবনের ছাদে আটকে ছিলেন, ঠিক সেই সময় নিচে আগুন লাগানো হয়। কয়েক ঘণ্টা পর তাঁদের উদ্ধার করা হয়। এখানে যে প্রশ্নটা তোলা যায়: টার্গেট কি কেবল ভবনটা, নাকি ভবনের ভেতরে থাকা মানুষগুলোও?

প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, উদীচী বা ছায়ানট—এগুলোর কেউই হাদির ওপর হামলার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত না। তারা হামলা পরিকল্পনা করেনি, সমর্থনও করেনি; বরং তাদের অনেক সাংবাদিকই প্রথম দিকে এ হামলার খবর করেছে এবং নিন্দা জানিয়েছে। আক্রান্ত পত্রিকা দুটি হাদির ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে ও উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্পাদকীয় ও কলাম প্রকাশ করেছে। তবু দেখা গেল, একই চেনা মুখেরা টেলিভিশনের টক শো, রাস্তার সমাবেশ আর ফেসবুক-ইউটিউব মিলিয়ে এই সব প্রতিষ্ঠানকে ‘সহযোগী’ বানিয়ে ফেলছে।

আমরা তাদের চেহারা চিনি: রাতের টক শোতে চিৎকার করে কথা বলে, দিনে মাইক হাতে উসকানি দেয়, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট-ক্যাম্পেইন চালায়। প্রকৃত হামলাকারী কারা, কার নির্দেশে, কার সংগঠনে হামলা হয়েছে, সেই প্রশ্ন করার বদলে তারা আবারও আগের ‘শত্রুর’ দিকেই আঙুল তুলছে, যেন সমালোচনামূলক পত্রিকা বা সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে টিকে থাকাটাই আসল অপরাধ।

এটা একধরনের কৌশল। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর দোষ চাপিয়ে তারা আসলে লড়াইয়ের ময়দানটাই বদলে দিতে চাইছে। বার্তাটা পরিষ্কার: যারা তাদের স্লোগান, তাদের রাজনৈতিক বয়ান, তাদের ইতিহাসের বয়ান পুরোপুরি মেনে নেবে না—এরা সবাই শত্রু।

যারা সরকারের দুর্বলতার সমালোচনা করেছে, আবার একই সঙ্গে অন্তত দুটি বড় রাজনৈতিক শিবিরের জনতুষ্টিবাদী কথাবার্তার বিরুদ্ধেও কথা বলেছে, এখন তাদেরই ‘প্রো-ফ্যাসিস্ট’ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এই লেবেল বা ট্যাগ দেওয়া খুব সুবিধাজনক; এতে আসল সহিংসতা থেকে দৃষ্টি সরে গিয়ে সেই সব মানুষের দিকে চলে যায়, যারা কেবল প্রশ্ন করছে।

এই যুক্তিতে একজন সাংবাদিক, কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পী বা দলমত-নির্বিশেষে সবার পক্ষে কথা বলা কোনো শিক্ষককে হত্যাকারীর সমান জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। একবার যখন এই সীমা পেরোনো হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে সবই ন্যায্য হয়ে যায়: হয়রানি, সামাজিক বয়কট, এমনকি শারীরিক আক্রমণও। সবকিছুর গায়ে আবার সুন্দর শব্দ বসানো হয়: ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’, ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা’, ‘দেশ পরিশুদ্ধ করা’। প্রতিশোধকে নৈতিকতার মোড়কে বেচা হয়।

আমরা যা দেখছি, তা শোককে পুরোনো হিসাব মিটিয়ে ফেলার ফাঁকা চেকে পরিণত করার চেষ্টা। প্রকৃত হামলাকারীদের দিকে, আর একজন নাগরিককে রক্ষা করতে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ক্ষোভ ঘুরিয়ে দেওয়ার বদলে, এরা হাদির কষ্টকে ব্যবহার করছে তাদের অপছন্দের সব কণ্ঠকে চুপ করিয়ে দিতে। তারা নিরাপদ বা ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে চায় না, তারা চায় এমন একটা বাংলাদেশ, যেখানে জনপরিসরে কেবল একধরনের কণ্ঠ থাকবে। এটা কোনো বিপ্লব না; এটা পুরোনো বাদ দেওয়া রাজনীতিরই নতুন পোশাক।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন কিছু না। জুলাই-আগস্টে আমরা দেখেছি ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার এ দেশের মানুষের ওপর কীভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সে সরকারের পতন শেষে মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন, নতুন সরকার প্রথমে দেশকে স্থিতিশীল করবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তারপর নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

হামলাকারীরা ডেইলি স্টার কার্যালয়ের ভেতর থেকে আসবাব ও কাগজপত্র বাইরে এনে তাতেও আগুন দেয়

তার বদলে আমরা দেখছি ঘৃণার সংস্কৃতি আরও ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে মাজার-দরগাহে হামলা হয়েছে, মৃতদেহ কবর থেকে টেনে বের করে জনসমক্ষে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথাও মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। নানা জায়গায় সাংস্কৃতিক পরিসরগুলো সংকুচিত করা হয়েছে। সমাজের কট্টরপন্থী অংশ নিজেদের মূলধারা ভাবছে এখন এবং এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, যেখানে কোনো বহুত্ববাদ বা বহু মত–চিন্তার অবস্থান থাকবে না। সরকারের পক্ষ থেকেও অনেক সময় এদের ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলে নরম করে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, যা এই হুমকির প্রকৃত গুরুত্ব ঢেকে দেয়।

যারা সরকারের এই দুর্বলতার সমালোচনা করেছে, আবার একই সঙ্গে অন্তত দুটি বড় রাজনৈতিক শিবিরের জনতুষ্টিবাদী কথাবার্তার বিরুদ্ধেও কথা বলেছে, এখন তাদেরই ‘প্রো-ফ্যাসিস্ট’ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এই লেবেল বা ট্যাগ দেওয়া খুব সুবিধাজনক; এতে আসল সহিংসতা থেকে দৃষ্টি সরে গিয়ে সেই সব মানুষের দিকে চলে যায়, যারা কেবল প্রশ্ন করছে।

এই পরিবেশ কত ভয়াবহ তা আমরা ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উঠে আসা অন্যতম পরিচিত মুখ ওসমান হাদি দিনের আলোয় নির্মম হামলার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক ও ফ্যাক্ট চেকাররা বারবার লিখেছেন, যিনি গুলি করেছেন, তিনি পতিত শক্তি আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সময়ের ব্যবধানে এ অভিযোগগুলো আইনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচাই-বাছাই হবে।

আরও পড়ুন

হাদি ভয়ংকর কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছেন। তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানো হয়েছে। অনেকেই চেয়েছেন অলৌকিক কিছু ঘটুক, যাতে তিনি ফিরে যেতে পারেন তাঁর ছোট সন্তানের কাছে, স্ত্রী ও মায়ের কাছে। সেই অলৌকিকতা ঘটেনি। হাদি এখন শহীদ, আর তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে নতুন করে প্রতিশোধের আগুন জ্বালানো হয়েছে।এর আগে ‘সাংস্কৃতিক ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দিয়ে কিছু মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বয়ান তৈরি করা হয়েছে। সেটিকে প্রতিশোধের ভাষা হিসেবে ব্যবহার হতে দেখলাম আমরা।

রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া হয়েছে বেছে বেছে, অনেকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে। যারা প্রকাশ্যে সহিংসতার ডাক দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে, একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেও জনতুষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে ঘৃণার রাজনীতি চালানো ব্যক্তিদের কাছে বার্তাটা স্পষ্ট গিয়েছে: ‘যা খুশি বলুন, যাকে খুশি টার্গেট করুন, আপনাদের কিছু হবে না।’

বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনা সেই আত্মবিশ্বাসেরই প্রকাশ। হাদির মৃত্যুর খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কয়েক শ মানুষ জড়ো করে দেশের শীর্ষ দুই দৈনিক ও একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে। সরকার তাদের থামাতে পারেনি, অথবা চায়নি। শুধু গোয়েন্দা ব্যর্থতা বা পুলিশের ব্যর্থতা দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটা মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যর্থতা। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, সংগঠিত সন্ত্রাসের সামনে রাষ্ট্র তার নাগরিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে রক্ষা করতে অক্ষম।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ যদি সত্যিই গণতন্ত্রের পথে ফিরতে চায়, তাহলে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই। যদি এই আন্দোলনকারীরা, তাদের সশস্ত্র অনুগামীরা এবং তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকেরা নির্বাচন ঠেকাতে বা দীর্ঘসূত্রতায় ফেলতে সফল হয়, তাহলে দেশ এমন এক বিশৃঙ্খলার দিকে যাবে, যার পরিণতি কল্পনা করাও কঠিন। যেখানে কে লিখবে, কে গান গাইবে, কে প্রকাশ করবে, সবকিছু মব ঠিক করে দেবে, সেই রাষ্ট্র তখন আর রাষ্ট্র হয়ে থাকতে পারে না।

তাই এখন দায়িত্ব শুধু সরকারের না, তাদেরও, যারা এখনো বহুত্ববাদী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। মানুষকে দাঁড়াতে হবে, স্পষ্ট ভাষায় বলতে হবে যে আমরা সব দল-মতের বৈচিত্র্য চাই, ভিন্নমত চাই; আমরা পত্রিকার স্বাধীনতা, সাংবাদিক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী এবং তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা চাই। সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব হচ্ছে তদন্ত করা, ভিডিওতে যাদের মুখ দেখা যাচ্ছে তাদের শনাক্ত করা, আদালতের মুখোমুখি করা।

যদি সরকার এটুকুও না করে, তাহলে বৃহস্পতিবার রাতে জ্বালানো আগুনই বলে দেবে, একটি গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসা একটি সরকার কীভাবে চরমভাবে ব্যর্থ হলো।

  • আসিফ বিন আলী ডক্টরাল ফেলো, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।
    ইমেইল: [email protected]

    *মতামত লেখকের নিজস্ব