আমরা এখন বৈশ্বিক অস্থিরতার যুগে বাস করছি। কোনো একক উৎপাদক বা দেশের ওপর যাতে অতিরিক্ত নির্ভরতা না থাকে, সে জন্য সরবরাহব্যবস্থাগুলো নতুন করে সাজানো হচ্ছে।
উচ্চ ও অনিশ্চিত শুল্কের কারণে এবং ভবিষ্যতে আরও শুল্ক বাড়ার আশঙ্কায় বাণিজ্যিক সম্পর্কগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
অংশীদার দেশগুলো একে অন্যের ওপর আর আগের মতো ভরসা করতে পারছে না। তাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়ায় দীর্ঘদিনের জোটগুলোও চাপে পড়ছে।
অবস্থা এতটাই খারাপ যে উত্তর আমেরিকার মতো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকা প্রতিবেশীরাও এখন একে অপরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে।
অন্যদিকে আট দশকের বেশি সময় ধরে যে কাঠামোগুলো বিশ্বে তুলনামূলক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল, সেগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
তবে সব অস্থিরতা সব সময় খারাপ হয় না। এ বছরের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ফিলিপ আগিয়োঁ, পিটার হাউইট ও জোয়েল মোকির দেখিয়েছেন—পরিবর্তন, ভাঙাগড়া আর পুরোনো ব্যবস্থার জায়গায় নতুন কিছু তৈরি হওয়াই অর্থনীতিকে গতিশীল করে এবং নতুন ভাবনা ও প্রযুক্তির জন্ম দেয়।
একে তাঁরা বলেছেন ‘সৃজনশীল ধ্বংস’। কিন্তু বিশ্বকে স্থিতিশীল রাখতে শুধু ভাঙচুর যথেষ্ট নয়।
একটি টেকসই বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হয় গড়ে তোলার মাধ্যমে। এর জন্য দরকার শক্তিশালী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাসযোগ্য ও দৃঢ় জোট, চাপ সহ্য করতে পারে এমন বাণিজ্যিক সম্পর্ক, আর আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো যৌথ নীতি।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর এই কথা বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত।
এই মুহূর্তে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এমন ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান ও জোট নেই। এটাকে সমস্যা নয়, বরং এখানকার নেতাদের জন্য একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেমন মিত্রদেশগুলো নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তেমনি ইন্দো-প্যাসিফিকের দেশগুলোও এখন নতুন কিছু তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডিন অ্যাচেসনের ভাষায় বলা যায়, তারা এখন একটি নতুন অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক ব্যবস্থার ‘শুরুর মুহূর্তে উপস্থিত’ থাকতে পারে।
এই নতুন কাঠামোই ভবিষ্যতে বিশাল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।
ইউক্রেনে যখন আগ্রাসী পুনর্দখলবাদ জোরদার হচ্ছে আর চীন এশিয়া ও তার বাইরেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, তখন এমন একটি কাঠামোর প্রয়োজন স্পষ্ট।
নিরাপত্তার প্রশ্নে কখনোই আত্মতুষ্ট হওয়া যায় না। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইন আমাদের এ শিক্ষাই দিয়েছিলেন। তিনি দূরের মনে হওয়া চেকোস্লোভাকিয়াকে অ্যাডলফ হিটলারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে তাতে যুদ্ধ এড়ানো যাবে।
কিন্তু সেই তোষণনীতিই একের পর এক ঘটনার জন্ম দেয়। এর পরিণতিতে এক বছর পর বড় যুদ্ধ শুরু হয়। অথচ চেম্বারলেইন ভেবেছিলেন, তিনি সে যুদ্ধ ঠেকাতে পারবেন।
ক্রমবর্ধমান অস্থিরতাকে উপেক্ষা না করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নেতাদের উচিত হবে প্রয়াত জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া, যেখানে অঞ্চলটি উন্মুক্ত, ঐক্যবদ্ধ, স্থিতিশীল ও নিরাপদ হতে পারবে।
বিদ্যমান কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে এই উদ্যোগ গড়ে উঠতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘কোয়াড’। কোয়াডে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র।
২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের ভয়াবহ সুনামির পর বহুপক্ষীয় সহযোগিতার উদ্যোগ হিসেবে এই জোট গঠিত হয়।
পরে ২০১৭ সালে শিনজো আবের নেতৃত্বে এটি নতুন করে সক্রিয় করা হয়। তখন থেকে এটি কৌশলগত সহযোগিতার একটি মঞ্চে পরিণত হয়। এর মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ও রয়েছে।
এখন এই সহযোগিতার কাঠামো আরও বিস্তৃত করা দরকার। সদস্য হিসেবে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রার্থী হলো দক্ষিণ কোরিয়া।
দেশটির নিরাপত্তাসংক্রান্ত উদ্বেগ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে। সৌদি আরবকেও ইন্দো-প্যাসিফিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
দেশটি নিজস্ব শক্তিশালী সামরিক আধুনিকায়নে যুক্ত রয়েছে। তাদের অর্থনীতি তেল রপ্তানিনির্ভর হওয়ায় ভারত মহাসাগরে নৌনিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাশাপাশি উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হিসেবে সৌদি আরব ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদারদের অনেক কিছু দিতে পারে। বিশেষ করে অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে সংযোগ তৈরির প্রবেশদ্বার হিসেবে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানকে বাদ দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না।
আসিয়ান তার সদস্যদেশগুলোর সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ না করেই সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের সুনাম অর্জন করেছে।
গত এক বছরে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম (যিনি অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত আসিয়ানের চেয়ারম্যান ছিলেন) ১১ সদস্যের এই জোটকে আরও শক্তিশালী করতে কাজ করেছেন।
তাঁর উদ্যোগের মধ্যে ছিল অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করা।
একই সঙ্গে আনোয়ার আসিয়ানের সঙ্গে এশিয়ার বাকি দেশগুলোর সম্পর্ক গভীর করার কাজ করেছেন। এর মধ্যে চীন যেমন ছিল, তেমনি ছিল যুক্তরাষ্ট্রও।
তিনি জোটের সম্প্রসারণেও ভূমিকা রাখেন। তিমুর-লেস্তেকে সদস্য হিসেবে স্বাগত জানিয়ে আসিয়ান একদিকে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে নতুন করে উত্তেজনা তৈরির ঝুঁকি কমিয়েছে, অন্যদিকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব আরও বিস্তৃত করেছে।
এদিকে অঞ্চলগত সম্পর্ক জোরদারের আরও কিছু উদ্যোগও গতি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শুল্কে ভারতের রপ্তানি প্রতিযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভারতীয় কোম্পানিগুলো এখন ক্রমেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে ঝুঁকছে। তারা আমিরাতকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পৌঁছানোর সেতু হিসেবে দেখছে। একই সঙ্গে এটি আরব বিশ্বের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ার একটি ধাপ এবং ভারতীয় শিল্পের জন্য পুঁজি সংগ্রহের একটি উৎস।
ভারত মহাসাগরের দিকে সাহসী সম্প্রসারণ আসিয়ান ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার কথা বলা যায়। শ্রীলঙ্কা আসিয়ানে যোগ দিলে ভারত মহাসাগরের মাঝখানে জোটের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি তৈরি হবে।
এতে ভারত, আফ্রিকা ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক জোরদার করা সহজ হবে।
ইতিবাচক খবর হলো, শ্রীলঙ্কা আসিয়ানের সদস্য হওয়ার কথা ভাবছে। ইতিমধ্যে তারা ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশিপ’-এর মাধ্যমে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।
সাফল্য সত্ত্বেও আসিয়ান এখন বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ এর একটি কারণ।
পাশাপাশি কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষও আবার শুরু হয়েছে। এ বছরের শুরুতে আনোয়ার ইব্রাহিম এই উত্তেজনা কিছুটা কমাতে সাহায্য করেছিলেন। তবে এই সংঘাত যে সমাধান–অযোগ্য, তা নয়। জাপান ও ভারতকে নিয়ে একটি যোগাযোগ গোষ্ঠী গঠন করা যেতে পারে।
এদিকে অঞ্চলগত সম্পর্ক জোরদারের আরও কিছু উদ্যোগও গতি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শুল্কে ভারতের রপ্তানি প্রতিযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভারতীয় কোম্পানিগুলো এখন ক্রমেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে ঝুঁকছে।
তারা আমিরাতকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পৌঁছানোর সেতু হিসেবে দেখছে। একই সঙ্গে এটি আরব বিশ্বের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ার একটি ধাপ এবং ভারতীয় শিল্পের জন্য পুঁজি সংগ্রহের একটি উৎস।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ঐক্য শুধু সম্ভবই নয়, বর্তমান অস্থিরতার যুগে এটি অপরিহার্য।
● আকিহিসা নাগাশিমা জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ