‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ জনপ্রশাসনকে অকার্যকর করছে

সাম্প্রতিক সময় প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গে বাড়াবাড়ি প্রকটভাবে লক্ষণীয় হচ্ছে। পক্ষান্তরে দেখা যাচ্ছে না এর যথার্থ কার্যকারিতা। তাই জনমনে আস্থার সংকটে আছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একে টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য। যেকোনো ধরনের সরকারব্যবস্থায় জনপ্রশাসনের বিকল্প নেই।

ঠিক তেমনি সে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া আইনি ক্ষমতার মধ্যে এর কর্মকর্তারা সীমিত না থাকলে বিপত্তি ঘটে বিভিন্ন পর্যায়ে। তাঁদের সীমিত রাখতে রয়েছে নানা ধরনের আইন ও বিধিবিধান। পাশাপাশি এসব কার্যকর করার জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যায়, কোনো কোনো কর্মকর্তা ক্ষেত্রবিশেষে সীমা লঙ্ঘন করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা নিজের আইনগত কর্তৃত্বের বাইরে যাচ্ছেন সময়ে সময়ে।

এসব যাঁদের দেখার কথা, তাঁরা একেবারেই কিছু দেখছেন না বা করছেন না, এমনটা বলা যাবে না। আবার আলোচিত কোনো কোনো বেপরোয়া আচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে যথোপযুক্ত সাজার আওতায় আনা যাচ্ছে না, এমনটাও দেখা যাচ্ছে। অথচ এ ধরনের আচরণ থেকে সবাইকে বিরত রাখতে সে সাজা হওয়া উচিত দৃষ্টান্তমূলক, বিধানও রয়েছে। কিন্তু যাঁরা প্রয়োগ করবেন, মনে হচ্ছে তাঁরা তা করছেন কম্পিত হাতে। এতে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার গ্লানিবোধ থাকে না সেই কর্মকর্তার।

বরং উত্তরোত্তর বেপরোয়া হওয়ার আশকারা পেয়ে যান তাঁরা। আর এর দেখাদেখি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা গোটা জনপ্রশাসনে। হাল আমলে কয়েকটি ক্ষেত্রে আমরা এ অবস্থা দেখে শঙ্কিত। জনপ্রশাসন সরকারব্যবস্থা পরিচালনার মৌলিক দায়িত্বে রয়েছে। সে দায়িত্ব থেকে তাঁদের কেউ কেউ অন্যায্য আচরণ করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। আবার তাঁদের কেউ কেউ নিজেরাই নিরাপদ নন তাঁদের কোনো জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর কাছে। সুস্পষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁদেরও হয় না তেমন কোনো শাস্তি। এতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যকারিতার পাশাপাশি প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টিও চলে আসছে সামনে।

সংবাদমাধ্যমের খবরে এসেছে, নিকট অতীতে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাঁর এক জুনিয়র নারী সহকারী কমিশনার ভূমির (এসি ল্যান্ড) সঙ্গে মোটামুটি লম্বা সময় ধরে হয়রানিমূলক অশালীন আচরণ করে আসছিলেন। আর তা করছিলেন কখনো তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে, আবার কখনো অফিসে বসিয়ে রেখে, বিভিন্ন বাক্যবাণে। নালিশ হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তদন্তে। শাস্তি হয়েছে অভিযুক্ত কর্মকর্তার। তাঁকে তিরস্কার করা হয়েছে। যেখানে আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে চলেছি, সেখানে এ জনপ্রশাসন অন্য দুর্বৃত্তদের হাতে নারী হয়রানি বন্ধ করার দায়িত্বে রয়েছে, সেখানে তাঁদেরই একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হয়রানি করছেন তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীকে। প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তির মাত্রা নামমাত্র। এটাকে তাৎপর্যহীন বললেও ভুল হবে না।

এই নামমাত্র শাস্তি সেই উৎপীড়ক কর্মকর্তার ওপর কি প্রভাব ফেলল? তিনি কি এ ধরনের অন্যায় করা থেকে বিরত হবেন? তাঁর মতো অন্য যাঁরা, তাঁরা এ থেকে কী শিক্ষা পেলেন? যিনি শাস্তির আদেশ দিলেন, তিনি কিন্তু এই নারী কর্মকর্তাকে তাঁর কনিষ্ঠ সহোদরা বা তনয়ার বিবেচনায় নেননি, এটা বলতেই পারি। অথচ পদমর্যাদার পার্থক্য, বয়স ও জনপ্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কাছে এটা প্রত্যাশিত ছিল। বরং অতি তুচ্ছ শাস্তি প্রয়োগ করে তিনি বিভাগীয় মামলাটি ‘নিষ্পত্তি’ করলেও ‘ইনসাফ’ করেননি, এমনটা বলা যায়। এতে আমরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ।

হতে পারে জনপ্রশাসনের কর্তারা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে প্রতিকারের কিছু উদ্যোগ আমরা অতীতে দেখেছি। সেগুলো ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে চলেছে। দৃশ্যমান অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে সবাই? আর শাস্তি দেওয়া হবে নামমাত্র লোকদেখানো! সময় এসেছে পেছনে ফেরার। আর তা না হলে জনপ্রশাসন সময়ান্তরে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে।

এরপর থাকছে একটি জেলার একজন সাবেক নারী জেলা প্রশাসকের কথা। প্রত্যাশিত যে নারী হয়ে তিনি কর্মক্ষেত্রে অযাচিত কার্যক্রম থেকে নিজেকে এবং পাশাপাশি গোটা জেলা প্রশাসনকে রাখবেন দূরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। তাঁর অধীন একাধিক কর্মকর্তা রাতের বেলা এক সাংবাদিককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে ডিসি অফিসে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে শাস্তি দেন। সাজাপ্রাপ্ত ভদ্রলোক একজন সাংবাদিক। প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক যাচ্ছিল না।

হতেই পারে। আর সে সাংবাদিকও করতে পারেন কোনো অন্যায্য কাজ। তবে প্রতিকার কি এভাবে করতে হবে! এতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় গোটা জেলা শহরে। যা-ই হোক, সে সময় সূচনাতে প্রশাসন সক্রিয় ছিল। বিভাগীয় মামলা ও তদন্ত হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে জেলা প্রশাসকের দুটি বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করার সাজা দেওয়া হয়। এটাও লঘু দণ্ড বলে বিবেচিত। এর মধ্যে কিছুদিন পরই আমরা দেখলাম, রাষ্ট্রপতি সে দণ্ডিত কর্মকর্তার আপিল গ্রহণ করে সাজা মার্জনা করেছেন। আমাদের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন, তা অনেকের জানা।

সংবিধান, রুলস অব বিজনেস ও সচিবালয় নির্দেশিকায় সেসব লিপিবদ্ধ আছে। কোন বিবেচনায় দণ্ডিত কর্মকর্তার সাজা মওকুফ হলো, তা বোধগম্য হলো না। হতে পারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। তবে সেটাও যুক্তিনির্ভর হতে হবে। এখানে দণ্ড মওকুফ করে একজন প্রমাণিত দোষীকে ছাড় দেওয়া হলো। এ সিদ্ধান্ত জনপ্রশাসনের চলার পথে ভালো অবদান রাখবে, এমনটা আশা করা যায় না। জানা যায়, সেই কর্মকর্তা এর মধ্যে একটি পদোন্নতিও পেয়েছেন। আশঙ্কা করছি, ভবিষ্যতে এ ধরনের বেপরোয়া আচরণ বেড়ে চলবে।

সবশেষে আসছি দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি উপজেলার একজন ইউএনও রাতে তাঁর সরকারি বাসভবনে দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত ও গুরুতর জখম হন। স্বাভাবিকভাবে সহানুভূতি পান তিনি। সরকারও নেয় ত্বরিত পদক্ষেপ। হেলিকপ্টার পাঠিয়ে ঢাকায় এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় তাঁর।

আরও পড়ুন

বদলিক্রমে স্বামীসহ তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। উল্লেখ্য, তাঁর স্বামীও অন্য ক্ষেত্রে একই পদে চাকরিরত ছিলেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সব ইউএনওর নিরাপত্তা বিধানের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেটা যথার্থ। দীর্ঘদিন চলে আহত ইউএনওর চিকিৎসা। এর মধ্যেই আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি, তাঁর সরকারি বাসভবনে রক্ষিত আলমারির তালা যথাযথ ব্যবস্থাপনায় খুলে সেখানে রক্ষিত ৪০ লাখ টাকা নিয়ে যান তাঁর ভাই। ধারণা করা হয়েছিল, এ টাকার উৎস নিয়ে একটি তদন্ত হবে। কেননা সংশ্লিষ্ট ইউএনও নিছক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মেয়ে।

বেতনের বাইরে তাঁর তেমন কোনো বৈধ আয় থাকার কথা নয়। আর বেতনের টাকার উদ্বৃত্ত এত টাকা হওয়া এবং তা ঘরের আলমারিতে রাখার কথাও নয়। সবাই চুপ মেরে গেলেন। কিন্তু যেখানে যা লিপিবদ্ধ থাকার কথা, সেখানে তো তা-ই আছে।

আক্রান্ত ও আহত ইউএনওর প্রতি আমাদের সহানুভূতি রয়েছে। সে মামলায় সংশ্লিষ্ট হামলাকারীর ন্যায়বিচার হোক, এটাও আমরা চাই। চাই সেই ইউএনওর পূর্ণ আরোগ্য, দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন। তবে তাঁকে টাকার হিসাব দিতে বলা তো একান্তই ন্যায্য। এমনকি দুদককে বিষয়টি দেখতে না বলার কোনো কারণও নেই। বিষয়টি তাঁর নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানে না, এমন বলা অসংগত হবে। আর ব্যাপারটা এভাবে ছেড়ে দেওয়া হবে সম্ভাব্য দুর্নীতিকে রীতিমতো প্রশ্রয় দেওয়া। জনপ্রশাসনের কোনো কোনো অঙ্গ জনগণের আস্থায় নেই, এটা বলা মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না।

আরও পড়ুন

সংবাদমাধ্যমের খবরে আমরা দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো উপাচার্য নিয়োগ–বাণিজ্যে জড়িত। ছাত্রী হলে সিট জোগাড় করতে সতীর্থদের দিতে হয় টাকা, তাঁদের কথামতো অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে হয়, এমনটাও শুনে চলছি। মানুষের জানমালের রক্ষক পুলিশের কেউ কেউ নিজেরাই ছিনতাই, ডাকাতি করে, এটাও দেখে চলেছি।

হতে পারে জনপ্রশাসনের কর্তারা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলে প্রতিকারের কিছু উদ্যোগ আমরা অতীতে দেখেছি। সেগুলো ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে চলেছে। দৃশ্যমান অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে সবাই? আর শাস্তি দেওয়া হবে নামমাত্র লোকদেখানো! সময় এসেছে পেছনে ফেরার। আর তা না হলে জনপ্রশাসন সময়ান্তরে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]