অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে সমস্যা কোথায়

একই দিনের দুটো শিরোনাম, ‘জাতীয় সংলাপে বিশিষ্টজনেরা: সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সংলাপের বিকল্প নেই’ এবং ‘ছাড় দিয়ে আপস-সমঝোতায় রাজি নয় আ.লীগ ও বিএনপি’। এ দুই শিরোনামে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা কতটা গভীর ও গুরুতর রূপ নিয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

একই দিনে অবশ্য অত্যন্ত অশোভন ও উদ্ভট আরেকটি শিরোনাম ছিল—যে লাফাবে, তার মাথায় ইউরেনিয়াম ঢেলে ঠান্ডা করে দেওয়ার হুমকি। এতে অবশ্য নব্বইয়ের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন দুই নেত্রী সম্পর্কে জেনারেল এরশাদের উপপ্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের অশালীন মন্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

প্রথম দুটি শিরোনামে যদি কারও মধ্যে আগামী নির্বাচন, শান্তি ও গণতন্ত্র সম্পর্কে ন্যূনতম আশাবাদও অবশিষ্ট থেকে থাকে, তৃতীয় শিরোনামে নিশ্চিত তা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

আরও পড়ুন

যথাসময়ে নির্বাচন চাই না—এমন কথা আমরা এখনো কারও মুখ থেকে শুনিনি, কোনো দলও বলেনি। বিরোধটা হচ্ছে কেমন নির্বাচন চাই, তা নিয়ে। মোটামুটি সবাই বলেছেন যে তাঁদের প্রত্যাশা একটা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। কিন্তু বিরোধটা বেধেছে গত দুই নির্বাচনে ভোট মূল্যহীন হয়ে পড়ায়। ২০১৪ সালে কেউ ভোট দেওয়ার আগেই ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়ে গেছে এবং তারা ও তাদের সহযোগী কয়েকটি দল ছাড়া আর কেউ সে নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেও সংলাপের পর ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনেই সবাই নির্বাচনে অংশ নিল। কিন্তু ভোটারদের যেমন আর ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের বাইরে অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি। এমনকি সরকারের অংশীদার সাবেক মন্ত্রীরাও অকপটে স্বীকার করেছেন, তাঁরাও ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি।

এ রকম দুটি সাজানো নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পটভূমিতে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই গণতন্ত্রসম্মত নির্বাচনের কথা এখন শুধু দেশের সরকারবিরোধীরা বলছেন তা নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বলছে, যার অগ্রভাগে আছে যুক্তরাষ্ট্র। বিদেশিদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীরা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন যে তাঁর সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবে, তবে তা হতে হবে সংবিধানের অধীন।

বিদেশিদের সুষ্ঠু নির্বাচন দাবির কারণে মাঝেমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে বিরক্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে এনে দেশটা যখন অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সবার এত মাতামাতি কেন?

আরও পড়ুন

সন্দেহ হয় রে! এটাই বলতে হয়—সন্দেহ হয় রে! আসল কথা নির্বাচনকে বানচাল করে দেওয়া।’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাওয়ায় আপত্তি কেন? নিজেদের মতো করে নির্বাচন সাজানোর পরিকল্পনা না থাকলে তো এমন আপত্তির কোনো কারণ নেই।

নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ভাষ্যকে যে শুধু বিরোধী দলগুলো গ্রহণ করছে না, তা-ই নয়; যাঁরা সক্রিয়ভাবে দল করেন না কিংবা সরকারের সুবিধাভোগী নন—নাগরিক সমাজের এমন প্রায় সবাই এখন সাজানো নির্বাচনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন এবং তার বিরুদ্ধে।

মাত্র দুই দিন আগেই ঢাকা ট্রিবিউন–এর ‘পলিটিকস ইজ ব্রোকেন: হাউ ডু উই ফিক্স ইট (রাজনীতি ভেঙে পড়েছে: কীভাবে আমরা তা ঠিক করব) শীর্ষক সেমিনারে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, একটি দল ক্ষমতায় এসে বিচারক, উপাচার্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে নিজেদের পছন্দের লোক বসায়। অন্য দল ক্ষমতায় এসেও একই কাজ করে। বছরের পর বছর ধরে এটি চলে আসছে। ফলে স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে করা সম্ভব।

আরও পড়ুন

অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরও বলেছেন, ‘পুরো ব্যবস্থার দলীয়করণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের একতরফা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করায় বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ছিল। যেসব কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এসেছিল, সে সমস্যাগুলো রয়ে গেছে।’ এ বাস্তবতা ক্ষমতাসীন দল অস্বীকার করলেও বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিকল্প তারা হাজির করতে পারেনি। ২০১৮ সালে একবার সুযোগ পেলেও সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার তাড়ায় তারা নিজেদের সংবরণ করতে পারেনি এবং সম্ভাবনা নষ্ট করেছে।

সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই বলে যে দাবি করা হচ্ছে, সেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এমনভাবে, যা ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি থেকে মুক্তি দিয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধনের কোনো ম্যান্ডেট চায়নি এবং ম্যান্ডেট ছাড়াই সংসদীয় কমিটির সুপারিশ এড়িয়ে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। অর্থাৎ সংকট ঘনীভূত হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের একতরফা বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে।

আরও পড়ুন

তাই সমাধান খুঁজতেও তাঁদেরই উদ্যোগী হওয়া উচিত। অথচ তাঁরা এখন বিরোধী দলের নেতাদের মোকাবিলায় তাঁদের মাথায় ইউরেনিয়াম ঢালতে চান। এর আগে ঢাকায় বিরোধীদের ঢুকতে দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে পুলিশও তাল মিলিয়ে বলেছে, বিনা অনুমতিতে ঢাকায় কাউকে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। রাস্তার মাঝখানে মঞ্চ বানিয়ে সমাবেশের অনুমতি পেতে অবশ্য আওয়ামী লীগের কোনো সমস্যাই হয়নি। পুলিশ অবশ্য বলতে পারে যে সেটা তো ছিল শান্তি সমাবেশ।

সবাই যে তাই সংঘাতের আশঙ্কা করছে, তা মোটেও ভিত্তিহীন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সংঘাতের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে কে লাভবান হবে? আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচন দেখতে আসবেন না। এখন যদি যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকেরাও নিরাপত্তার দুশ্চিন্তায় না আসেন, তাহলে পশ্চিমাদের নজরদারি এড়ানো সহজ হয়। আন্তর্জাতিক নজরদারি যত কম হয়, ততই ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হয়। আগের দুই নির্বাচনে সে রকমই দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

গত দুই নির্বাচনে পর্যবেক্ষণে এসেছেন সরকারের পছন্দের কিছু পর্যবেক্ষক এবং প্রধানত প্রতিবেশী দেশ থেকে। তাঁদের চোখে কোনো অনিয়ম পড়েনি। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায়, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশের চিন্তক ও সাংবাদিকদের অনেকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের নির্বাচনসম্পর্কিত নীতির কড়া সমালোচনায় সরব হয়েছেন।

তাঁরা শুধু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও তাঁদের এসব সমালোচনা তুলে ধরছেন। ব্লুমবার্গওয়াশিংটন পোস্ট–এ সদ্য প্রকাশিত এক নিবন্ধে দিল্লির অবজারভার ফাউন্ডেশনের মিহির শর্মা লিখেছেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হলে সরকারবিরোধীরা শক্তিশালী হবে এবং মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে। স্পষ্টতই তাঁদের ধারণা, সুষ্ঠু নির্বাচন মানে সরকার পরিবর্তন, ক্ষমতাসীনদের ম্যান্ডেট নবায়ন নয়।

এ পটভূমিতে আমরা কেমন নির্বাচন চাই, সে নির্বাচন কীভাবে হবে, তার জন্য সংলাপ ছাড়াও অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান। তাঁর কথায়, ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য রাজনৈতিক ও আইনি সংস্কার দরকার। কিন্তু শুধু আইনি সংস্কার করেই সমস্যার সমাধান হবে না; বড় দুই দলের মধ্যে এমন একটি বোঝাপড়া হতে পারে যে যারা ক্ষমতায় যাবে, তারা বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে না।’ প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিশোধের রাজনীতি বর্জনের অঙ্গীকার কি আমরা আদৌ শুনতে পাব?

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক